সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিনিয়োগ সম্মেলনকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের একটি বড় সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই সম্মেলনে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভারত, সিঙ্গাপুর, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ ৫০টি দেশের ৫৫০ জন বিনিয়োগকারী অংশ নিয়েছেন। তাঁদের বড় অংশই বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ ও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বিনিয়োগ সম্মেলনে বাংলা ইউএস এলএলসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. মুমতাজুর রহমান দাউদ বাংলাদেশে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের যুগান্তকারী বিনিয়োগ পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। তিনি চট্টগ্রামে ৬০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে একটি সার কারখানা নির্মাণের কথাও বলেন।
আমাদের জনসংখ্যা বাড়ছে, জমি ও পানির প্রাপ্যতা কমছে এবং এর ওপর আসছে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব। সব মিলিয়ে আগামী দিনের কৃষি খুবই চ্যালেঞ্জিং। দেশের বর্ধিষ্ণু জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষি খাত তথা শস্য, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ ও বনায়ন খাতের গুরুত্ব অত্যধিক। দেশ এখন খোরপোশ কৃষি থেকে আধুনিক বাণিজ্যিক কৃষির দিকে ধাবমান। কৃষির সঙ্গে প্রতিনিয়ত বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক ধারণা এবং প্রযুক্তি যুক্ত হচ্ছে। কৃষিবিজ্ঞানীদের নব নব উদ্ভাবন কৃষিতে নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে দেশের কৃষিতে বড় বিনিয়োগ দরকার। তা দেশে-বিদেশে বসবাসরত ধনাঢ্য ব্যক্তি ও উন্নয়ন সহযোগীদের দ্বারা সম্ভব। বহু দেশের যুদ্ধের কারণে বিশ্বের খাদ্য ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অবনমন অবস্থায় দেখা যায়। এমতাবস্থায় ভবিষ্যৎ খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে কৃষিতে বড় বিনিয়োগের বিকল্প নেই।
আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য বহুমুখী উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব অত্যধিক। দেশের কৃষিজ পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে ভ্যালু অ্যাডেড পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। রপ্তানিযোগ্য এসব পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে হলে এ খাতে বিনিয়োগ দরকার। বিদেশে রপ্তানি বাজার আরও সম্প্রসারণ জরুরি। অঞ্চলভিত্তিক বাণিজ্যিক এলাকায় প্রক্রিয়াজাতকরণ সুযোগসুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চলে উদ্যোক্তা তৈরি করা গেলে মানুষের আয় বাড়বে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কৃষি খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশ কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদে ইতোমধ্যে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। দেশ এখন বিভিন্ন খাদ্যশস্য উৎপাদনে বেশ এগিয়ে। বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের কৃষি মাথা উঁচু করে দাঁড়াক সেটি সবার প্রত্যাশা। এ প্রত্যাশাকে দৃশ্যমান, যুগোপযোগী ও রপ্তানিমুখী বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তর করতে প্রয়োজন বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ। এ বিনিয়োগ সাধারণ কৃষকের পক্ষে সম্ভব নয়। দেশের বিভিন্ন খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা বেশ দৃশ্যমান ও প্রশংসিত। দেশের উর্বর কৃষিজমি ও দক্ষ জনবল বিনিয়োগের জন্য একটি অনুকূল দিক। কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প স্থাপন ও প্রসারে বিনিয়োগের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীদের বিনিয়োগে কৃষি খাত শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে।
৭-১০ এপ্রিল ২০২৫ অনুষ্ঠিত বিনিয়োগ সম্মেলন মানুষের মনে বেশ আশা জাগিয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে শাকসবজি, ফলমূল, মাছ, প্রাণিসম্পদসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য রপ্তানির সম্ভাবনা অনেক। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কৃষিপণ্য রপ্তানি হচ্ছে, যা মূলত প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে। বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশে প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য বিদেশের মূল বাজারে প্রবেশাধিকারের সুযোগ বাড়বে। সেজন্য নিরাপদ ও মানসম্মত কৃষিপণ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, আধুনিক মানের প্যাক-হাউস নির্মাণ, দক্ষ জনবল তৈরি, আপদ মোকাবিলায় সরকারিভাবে ধান বা চাল সংরক্ষণে বেশিসংখ্যক গুদাম স্থাপন, অঞ্চলভিত্তিক কৃষিপণ্যের সংরক্ষণাগার স্থাপন, কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক জোন চালুকরণ ও অ্যাক্রেডিটেড ল্যাব স্থাপনসহ আরও অনেক উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা ও কৃষি খাতের উন্নয়নে এবং কৃষিখাদ্য ব্যবস্থার রূপান্তর করতে বিনিয়োগ উদ্বুদ্ধকরণ প্রয়োজন। অ্যাগ্রোপ্রসেসিং, মার্কেটিং, কমার্শিয়ালাইজেশন, ক্লাইমেটস্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার, টেকনোলজি ডেভেলপমেন্ট ও ডেসিমিনেশন, জলবায়ু প্রভাব মোকাবিলায় সহনশীল প্রযুক্তি বা জাত উদ্ভাবন, বিশেষায়িত ও মাল্টিপারপাস কোল্ড স্টোরেজ স্থাপনের চাহিদা রয়েছে দেশে অনেক। কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণে অবকাঠামো উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন, বিদ্যুৎ, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনাতে বিনিয়োগের সুযোগ অনেক। উন্নয়ন সহযোগীদের বিনিয়োগের চেষ্টা করা বর্তমান সরকারের একটি ইতিবাচক দিক।
লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট