বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান সংকটকে প্রস্তাবিত বাজেটেও আমলে নেওয়া হয়নি বলে মন্তব্য করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের সংকট মোকাবেলায় তাঁদের বিষয়গুলোও আমলে নেওয়া হয়নি বলেও দাবি তাদের। মঙ্গলবার (৩ জুন) বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে এমন মন্তব্য করেন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে বেশ কিছু ইতিবাচক দিক থাকলেও সামগ্রিকভাবে চলমান অর্থনৈতিক সংকট আমলে নেওয়া হয়নি।
সংবাদ সম্মেলনে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন তিনি। এ সময় সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমানও বক্তব্য দেন।
বাজেটের নানা দিক তুলে ধরে ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রাজস্বসংক্রান্ত বেশ কিছু উদ্যোগ বাজেটে ঘোষিত সমতামুখী ও টেকসই উন্নয়নকাঠামোর ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বাজেটে বৈষম্য কমানোর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
বাজেটের মূল দর্শন হওয়া উচিত ছিল রাজস্বনীতির মাধ্যমে আয়বৈষম্য হ্রাস। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের আন্দোলনেও এটি প্রধান দাবি হিসেবে উঠে এসেছে।
তিনি আরো বলেন, বাজেটে কর ও অন্যান্য নীতির মাধ্যমে বৈষম্য কমানোর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। ফলে নীতিগত দিক থেকে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত মেলে না।
কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে—সিপিডি নৈতিকভাবে তা সমর্থন করে না। অথচ বাজেটে পাচারকৃত অর্থ সম্পর্কে স্পষ্ট খতিয়ান উপস্থাপন করা হয়নি।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, এই যে জুলাই আন্দোলন হলো, সেটা তো বৈষম্যহীন সমাজের জন্য আন্দোলন হয়েছিল। বাজেটেও বলা হচ্ছে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করার কথা। সেটার সঙ্গে এটা চরমভাবে সাংঘর্ষিক।
বৈষম্যহীন স্পিরিটের সঙ্গে বাজেটের পদক্ষেপগুলো সাযুজ্যপূর্ণ নয়। এটি বৈষম্য আরো বাড়াবে। বাজেটের অন্যান্য ক্ষেত্রেও বৈষম্য সৃষ্টির পদেক্ষপ রয়েছে দাবি করে তার উদাহরণ হিসেবে নতুন কর বিন্যাস এবং নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের ওপর বেশি কর চাপানোর বিষয়গুলো তুলে ধরেন তিনি।
ফাহমিদা বলেন, ‘বার্ষিক ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের মানুষকে কর দিতে হবে সাড়ে বারো শতাংশ, বার্ষিক ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত যাঁরা আয় করেন তাঁদের দিতে হবে ১৬.৭ শতাংশ। কিন্তু ৩০ লাখ টাকার বেশি যাঁরা আয় করবেন, তাঁদের কর দিতে হবে মাত্র ৭.৬ শতাংশ। অর্থাৎ যাঁরা মধ্যম ও নিম্ন আয়ের মানুষ, তাঁদের ওপরই বেশি কর চাপানো হয়েছে। বাজেটে বৈষম্য দূরীকরণের কথা বলা হলেও বৈষম্যটা দূর হচ্ছে না। বরং এটা বাড়ার দিকেই আমরা দেখছি।’
ফাহমিদা বলেন, অর্থ উপদেষ্টা ১১০টি পণ্যের ওপর থেকে আমদানি শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার, ৯টি পণ্যের ওপর থেকে সম্পূরক শুল্ক বাতিল এবং আরো ৫০৭টি পণ্যের ওপর শুল্ক হ্রাসের প্রস্তাব করেছেন। যদি যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্কে ছাড় দেওয়া হয়, তাহলে অন্য দেশকেও দিতে হবে। না হলে ডব্লিউটিওর নিয়ম লঙ্ঘিত হবে। পাশাপাশি এনবিআরের রাজস্ব আয়েও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রকে বা নির্দিষ্ট কোনো দেশকে অগ্রাধিকার দিলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ‘সর্বাধিক সুবিধাপ্রাপ্ত দেশ’ (এমএফএন) নীতির লঙ্ঘন হতে পারে এবং তাতে ভবিষ্যতের বাণিজ্য আলোচনায় বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল হতে পারে।
ফাহমিদা বলেন, ‘এবারও উচ্চ আকাঙ্ক্ষার রাজস্ব আহরণ বাজেটের বড় চিন্তার বিষয়। ১০ বছর ধরেই আমরা দেখছি, লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয় না।’ রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে বড় ধরনের সংস্কার কার্যক্রম লাগবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মূল্যস্ফীতি ও উচ্চহারে খেলাপি ঋণের কারণে অর্থনীতি যে একটি চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তেমন পরিস্থিতিতে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা আনা এবং মূল্যস্ফীতি কমানোই আগামী বাজেটের মূল্য লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল বলে মন্তব্য করেন ফাহমিদা।
তিনি বলেন, এই প্রস্তাব বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা তৈরি করে ‘বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের’ বাজেট ঘোষণার মূল অঙ্গীকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সিপিডি মনে করে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনার প্রতি সম্মান জানাতে হলে বাজেট থেকে এই বিতর্কিত প্রস্তাব প্রত্যাহার করা জরুরি।
এ ছাড়া বাজেটে প্রবৃদ্ধির বদলে সামগ্রিক উন্নয়ন এবং অবকাঠামোর বদলে মানুষের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার যে কথা বলা হয়েছে, কিছু কিছু উদ্যোগ তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে মনে করে সিপিডি। করকাঠামো বিন্যাস করতে গিয়ে ছয়টি শ্রেণি করা হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, নিম্নবিত্ত মানুষের করহার বেশি হবে, কিন্তু উচ্চবিত্তদের কম পড়বে। এটা বৈষম্যমূলক।
উন্নয়ন বাজেটের আকার নিয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, উন্নয়ন বাজেটের আকার এবার ছোট করা হয়েছে। তবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষিতে উন্নয়ন ব্যয় কমানো উদ্বেগজনক।
বিডি প্রতিদিন/মুসা