২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম মহানগরের আগ্রাবাদ বাদামতল এলাকার ফুটপাত দিয়ে হাঁটার সময় নালায় পড়ে মারা যান সেহেরীন মাহবুব সাদি। তিনি আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। এ ঘটনার পরপরই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) উদ্যোগে বাঁশের ঘেরাও দেওয়া হয়। চসিক তখনই ঘোষণা দিয়েছিল নগরের সব উন্মুক্ত নালা-খালের পাড়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী দেওয়ার। কিন্তু তা কেবল ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ। এরপর নগরে খাল-নালায় পড়ে অন্তত ১৪ জন মারা যান এবং নিখোঁজ হন আরও অনেকে। সর্বশেষ শুক্রবার রাতে নগরের কাপাসগোলায় ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ন্ত্রণ হারালে হিজড়া খালে পড়ে যায় ছয় মাস বয়সি এক শিশু, শিশুটির মা ও দাদি। গতকাল সকালে শিশুটির লাশ উদ্ধার করা হয়।
নগরের অধিকাংশ খাল-নালার পাড় এখনো উন্মুক্ত। ঝুঁকি নিয়ে পথচারী ও যানবাহন চলাচল করছে। মৃত্যু-নিখোঁজের মতো বড় দুর্ঘটনা ঘটলেই টনক নড়ে। এরপর আবারও সব উদ্যোগ-তৎপরতা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। দুর্ঘটনার পর বাঁশের ঘেরাও দিয়ে দায়িত্ব শেষ করে চসিক। তা ছাড়া খাল-নালায় পড়ে মৃত্যু বা নিখোঁজের কোনো তালিকা নেই কোনো সংস্থার কাছেই। নগরবাসীর অভিযোগ, প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমে উন্মুক্ত খাল-নালায় পড়ে মৃত্যু ও নিখোঁজের ঘটনা ঘটে। ঘটনার পরই চসিক কিছুটা তৎপর হয়। এরপর আবারও সব হিমাগারে
চলে যায়। পৃথিবীর কোনো সভ্য শহরে এমন ঘটনার বারবার পুনরাবৃত্তি হয় কি না সন্দেহ। কিন্তু চার বছর ধরে এমনটিই ঘটে আসছে। জানি না, আর কত মৃত্যু হলে কর্তৃপক্ষগুলোর টনক নড়বে।
নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি আশিক ইমরান চৌধুরী বলেন, ঘটনাস্থলটা পুরোই আবর্জনার ভাগাড়। শিশু নয়, বড়রাও এখানে পড়লে হারিয়ে যাবে। বৃষ্টিতে খাল-নালা ও সড়ক একাকার। অথচ চসিকের উচিত ছিল বর্ষার আগেই ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো চিহ্নিত করে লাল-সবুজ ফিতা দিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজগুলো করা। চসিক-সিডিএকে নাগরিকের প্রতি দায়বদ্ধতার জয়গায় আসতে হবে। তিনি আরও বলেন, এখনই উচিত সিডিএ, চসিক, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করে বিপজ্জনক স্থান চিহ্নিত করা। কাজটা করতে হবে বর্ষার আগেই। বিপজ্জনকের বিষয়টা অবশ্যই জনগণকে অবহিত করতে হবে কারণ নাগরিকরা কর দিচ্ছেন। এর বিপরীতে তাদের সেবা দিতে হবে। অন্যথায় প্রাণহানি কমবে না। চট্টগ্রাম ডেভেলপমেন্ট ফোরামের যুগ্ম আহ্বায়ক খোরশেদুল আলম বলেন, চার বছর ধরেই দেখছি খাল-নালায় পড়ে মৃত্যু ও নিখোঁজ। এভাবে আর কত লাশ দেখতে হবে আমাদের? কর্তৃপক্ষ আর কত নির্বিকার থাকবেন বলে প্রশ্ন রাখেন তিনি। চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘খাল-নালায় পড়ে মৃত্যু-নিখোঁজ দুঃখজনক। বিষয়টা নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর উদ্যোগ নেব। শিগগির এ জায়গায় রেলিং দেওয়া হবে।’ চসিক সূত্রে জানা যায়, নগরে খাল-নালা আছে ১ হাজার ১৩৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে নিরাপত্তাবেষ্টনী ছাড়া খালের পাড় আছে প্রায় ১৯ কিলোমিটার। উন্মুক্ত নালা রয়েছে ৫ হাজার ৫২৭টি স্থানে। এর মধ্যে ১০ শতাংশ নালায়ও নিরাপত্তাবেষ্টনীর কাজ হয়নি। নগরীতে মোট ১৬১ কিলোমিটারের ছোটবড় ৫৭টি খাল এবং ৭৬৫ কিলোমিটার নর্দমা আছে। মেগা প্রকল্পের অধীনে বর্তমানে ৩৬টি খালের সংস্কার-উন্নয়ন কাজ চললেও ২১টি খাল এখনো বেহাল।
১৩ ঘণ্টা পর ভেসে উঠল নিখোঁজ শিশুর লাশ : চট্টগ্রাম নগরের চকবাজার থানাধীন কাপাসগোলা এলাকার হিজড়া খালে ছয় মাস বয়সি এক শিশু গত শুক্রবার রাত ৮টার দিকে নিখোঁজ হয়। দীর্ঘ সময় তল্লাশি করেও শিশুটির সন্ধান পাওয়া যায়নি। অবশেষে গতকাল সকাল ৮টার দিকে ঘটনাস্থল থেকে ২ কিলোমিটার দূরে নগরের চাক্তাই খালের আছাদগঞ্জের চামড়া গুদাম মোড়ের পার্শ্ববর্তী অংশে শিশুটির লাশ দেখতে পান স্থানীয়রা। পরে খবর দিলে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস লাশটি উদ্ধার করে। স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল সাড়ে ৮টার দিকে চা খাওয়ার সময় কয়েকজন যুবক হঠাৎ একটি শিশুর লাশ দেখতে পান। তারা লাশটি তুলে আনেন। এরপর স্থানীয়রা জড়ো হতে থাকেন। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজন এসে লাশটি উদ্ধার করেন।
শিশুটির নাম সেহরিশ। মায়ের নাম সালমা বেগম ও বাবার নাম মো. শহীদ। তারা নগরের আছাদগঞ্জ এলাকায় থাকেন। চকবাজারের কাপাসগোলা এলাকায় মো. শহীদের বোনের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন সালমা বেগম, শিশু সেহরিশ ও তার দাদি। এটি তার প্রথম সন্তান। ফেরার পথে অটোরিকশা ঘোরাতে গিয়ে সেটি খালের মধ্যে পড়ে যায়।
গত শুক্রবার রাত ৮টার দিকে নগরের চকবাজার থানাধীন কাপাসগোলা এলাকার হিজড়া খালে ছয় মাস বয়সি এক শিশু, শিশুর মা ও দাদিসহ তিনজন যাত্রীসহ একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা পড়ে যায়। এ সময় খালে পানির স্রোত ছিল। ঘটনার পর রাত ১০টার দিকে অনতিদূরের খাল থেকে এসস্কেভেটরের সহায়তায় মা ও দাদিকে উদ্ধার করা গেলেও শিশুটি পানির স্র্রোতে তলিয়ে যায়।