ভবিষ্যতে যাতে বিতর্কিত কোনো ব্যক্তি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ না হতে পারেন সেজন্য আপিল বিভাগের সিনিয়র মোস্ট বিচারপতিদের মধ্যে অন্তত দু-তিন জনের মধ্য থেকে নিয়োগের পক্ষে বিএনপি। বিএনপির পক্ষ থেকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানো এবং ১৪ সদস্যের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রস্তাব করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে পৃথক প্রস্তাব দিয়েছে দলটি। গতকাল জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে তৃতীয় দফায় সংলাপে এ প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে সংলাপে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে সংলাপে অংশ নেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ইসমাইল জবিউল্লাহ, সাবেক সচিব আবু মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল।
বৈঠক শেষে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিএনপি বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত যে অধ্যাদেশ জারি করেছে, সেটি হাই কোর্টে চ্যালেঞ্জ হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের সচিবালয় প্রতিষ্ঠার জন্য যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, এটিসহ আমরা বিচার বিভাগের সম্পূর্ণ স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। এটি বাস্তবায়নে আমাদের অঙ্গীকার আছে।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের সুপারিশ করেছে বিচারব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। বিষয়টিতে দ্বিমত জানিয়েছে বিএনপি। তিনি বলেন, উনাদের প্রস্তাব ছিল আপিল বিভাগের সিনিয়র মোস্ট যেন পরবর্তীতে প্রধান বিচারপতি হন। আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে রাষ্ট্রের মধ্যে কিছু অসঙ্গতি আগে দেখা গেছে। সর্বক্ষেত্রে আমরা যদি নির্দিষ্ট করে দিই, কোনো বিকল্প না থাকলে, ভবিষ্যতে যেহেতু আমরা বিচারবিভাগকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করতে চাই, সে ক্ষেত্রে আগের মতো কোনো বিতর্কিত ব্যক্তি প্রধান বিচারপতি হন, এটি রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর হবে না। তিনি বলেন, এখানে একটা অন্তত বিকল্প থাকা উচিত। আপিল বিভাগের সিনিয়র মোস্ট বিচারপতিদের মধ্যে কমছে কম দু-তিনজন এ অপশনে থাকেন। সেই জায়গাটা এখনো গৃহীত হয়নি। এখনো আলোচনা চলছে। সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা হচ্ছে সর্বোচ্চ আইন।
একজন সর্বোচ্চ দুবার প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের এমন প্রস্তাবে দ্বিমত জানিয়েছে বিএনপি। দলটির প্রস্তাবে বলা আছে, দুবারের পর বিরতি দিয়ে আবারও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ আছে। তবে রবিবার মুলতবি হওয়া বৈঠকের আলোচনায় একজন সর্বোচ্চ তিনবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন এমন কথা হয়। বিষয়টি বিএনপিও ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে। এ বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিকল্প প্রস্তাবের জন্য অপেক্ষা করেন। আর তারা ফরমালি প্রস্তাবটি আমাদের দেননি। তিনি আরও বলেন, একজন ব্যক্তি যাতে প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান এবং সংসদ নেতা পদে না থাকেন সেটি নিয়ে আলাপ হয়েছে। এখানে যে মেজরিটি পার্টি সংসদে সংসদীয় দল হয়, সেই পার্টি সিদ্ধান্ত নেয়, কে প্রধানমন্ত্রী হবেন। এটা জরুরি নয় যে, পার্টির প্রধান প্রধানমন্ত্রী হবেন। এমন উদাহরণ আছে। কিন্তু হওয়ার অপশন রাখা উচিত। আর প্রধানমন্ত্রী যিনি হবেন, তিনিই সংসদ নেতা হবেন। এটা ট্রেডিশন। কোনো কোনো দেশ সংসদ নেতাকে আলাদা করেছে এমন নজির আছে। কিন্তু এখানে সংসদ নেতার কোনো নির্বাহী ক্ষমতা নেই। এখানে সংসদ নেতা এবং প্রধানমন্ত্রী অনেকটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটা প্রধানমন্ত্রীর মতো আলাদা পোস্ট নয়। কয়েকটা জায়গায় শুধু সংসদ নেতার উল্লেখ আছে। সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধির কথা আমরা বলেছি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা না করে রাষ্ট্রপতি কী কী করতে পারবেন সেটা বিস্তারিত থাকবে। এটা এ মুহূর্তে আমরা উন্মোচন করছি না। দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টে বিএনপি একমত বলে জানান সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, আইনসভার ক্ষেত্রে উনারা নাম রেখেছেন উচ্চ কক্ষের জন্য সিনেট, নিম্ন কক্ষের নাম জাতীয় সংসদ। এটাতে আমরা একমত। নিম্ন কক্ষের ৪০০ আসনের মধ্যে ১০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে এটা নিয়ে আমরা একমত, তবে সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে আমাদের মধ্যে ভিন্নমত আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাম লীর সদস্য ১৪ জন হবে, এর সঙ্গে একমত। উপদেষ্টাম লীর কার্যাবলির রুটিন ওয়ার্কের ক্ষেত্রে একমত। প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করলে, উপদেষ্টাম লীর সদস্য থেকে একজনকে মনোনীত করা হবে, সে বিষয়ে একমত। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে একমত। স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ করা হবে না, এ ব্যাপারে আমরা সম্পূর্ণ একমত। তিনি আরও বলেন, শৃঙ্খলাবাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে আমরা মোটামুটি একমত। তবে এটা আরও বিস্তারিত আলোচনা করা দরকার। কারণ শৃঙ্খলাবাহিনী বলতে সশস্ত্র বাহিনীর তিন বিভাগসহ পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনী সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত আছে। সুতরাং ঢালাওভাবে শৃঙ্খলাবাহিনীর ক্ষেত্রে একটি প্রোভেশন রাখি হঠাৎ করে, তাহলে ইনব্যালেন্স হয়ে যেতে পারে। সেজন্য এটা আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার। একটি জিনিসে ঐকমত্যে আসা যায়। কিন্তু যেটা রাষ্ট্রের বিষয়, সংবিধধানের বিষয়, রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়, সেটা গভীরভাবে চিন্তা করে সংবিধানে আনতে হবে।
সংলাপে নতুন প্রস্তাব এসেছে- আলী রীয়াজ : রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে নতুন নতুন প্রস্তাব এসেছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। বিএনপির সঙ্গে সংলাপের সূচনা বক্তব্যে তিনি বলেন, আলোচনায় নতুন প্রস্তাব এসেছে। সেগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট কমিশনগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। কারণ এগুলো সংস্কার কমিশনগুলোর কাছ থেকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে এসেছে। প্রথম পর্যায়ের আলোচনায় বিএনপির সঙ্গে কিছু বিষয়ে একমত হওয়া গেছে জানিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে বেশ কিছু বিষয়ে সামঞ্জস্যতা আছে, বেশ কিছু বিষয়ে মতভিন্নতাও আছে। মতভিন্নতার ক্ষেত্রে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- অনেক ক্ষেত্রে তারা নীতিনির্ধারকদের কাছে যাবেন, আলোচনা করবেন এবং পরবর্তী সময়ে আমাদের জানাবেন।