কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ নতুন কিছু নয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর থেকে দ্ইু প্রতিবেশী দেশের মধ্যে তিনটি যুদ্ধ সংঘটিত হওয়া ছাড়াও অসংখ্য সীমান্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। গত ২২ এপ্রিল ভারত অধীকৃত কাশ্মীরের পেহেলগামে তথাকথিত জঙ্গি হামলায় ২৬ পর্যটক নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারত হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের হুমকি দিয়েছে। এই লক্ষ্যে তারা ইতোমধ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বেশ কিছু কূটনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এমনকি ১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় দুই দেশের মধ্যে সম্পাদিত সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি বাতিল করার হুমকিও প্রদান করেছে। পাকিস্তান পেহেলগামের হত্যাকাণ্ডে তাদের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করে ঘটনার স্বাধীন তদন্তের প্রস্তাব দিয়েছে এবং ভারতের গৃহীত পদক্ষেপের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ভারতীয় বিমানের জন্য তাদের আকাশসীমা ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে। তা ছাড়া পাকিস্তান হুমকি দিয়েছে যে ভারত যদি দুই দেশের মধ্যে চুক্তি লঙ্ঘন করে অভিন্ন নদীর পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দেয়, তাহলে পাকিস্তান প্রয়োজনে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের দ্বিধা করবে না। উদ্ভূত পরিস্থিতি যাতে সর্বাত্মক যুদ্ধের রূপ ধারণ না করে সেজন্য চীন উভয় পক্ষকে ‘সংযমী’ হতে এবং যুক্তরাষ্ট্র ‘যৌক্তিক সমাধানে’ উপনীত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
পারমাণবিক শক্তির অধিকারী ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধের হুমকিতে দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে আতঙ্কের সৃষ্টি হলেও এখন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলেও তা ব্যাপক বা সর্বাত্মক যুদ্ধের রূপ নেবে না বলেই আমার বিশ্বাস। ভারত ২০১৯ সালের আগস্টে বিরোধপূর্ণ কাশ্মীরের ভারত অধীকৃত অংশের বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা বিলোপ করার পর থেকে কাশ্মীরি জনগণের ক্ষোভ আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পেহেলগামের ঘটনা তারই একটি বহিঃপ্রকাশ। ভারতের বর্তমান উগ্রপন্থি বিজেপি সরকার নির্বাচনকে সামনে রেখে এ ঘটনার সৃষ্টি করেছে বলে ভারতীয় অনেক রাজনৈতিক ও সাবেক ভারতীয় সেনাধ্যক্ষরা মনে করেন। তবে একশ্রেণির গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পেহেলগামের ঘটনাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচার করে ‘যুদ্ধ অনিবার্য’ ধরনের আবহ সৃষ্টি করতে সচেষ্ট।
১৯৪৭ সালে কাশ্মীরের একটি অংশকে ভারত অধিকার করে নেয় সেখানকার জনগণের মতামতের প্রতিফলনের সুযোগ না দিয়ে। কাশ্মীরের শেষ মহারাজা হরি সিংয়ের ভারতে যোগ দেওয়ার বিতর্কিত সিদ্ধান্ত জনগণ কখনো মেনে নেয়নি। কাশ্মীরের বিভিন্ন উপজাতির লোকজন মহারাজা হরি সিংয়ের কবল থেকে কাশ্মীরকে মুক্ত করার জন্য যখন রাজধানী শ্রীনগরের উদ্দেশে ধেয়ে আসছিল, তখন হরি সিং নিজেকে রক্ষার জন্য ভারতের সৈন্য সাহায্য কামনা করেন। তিনি ভারতে অন্তর্ভুক্তির দলিলে স্বাক্ষর করলেই তাকে সেনা সহায়তা পাঠানো সম্ভব বলে প্রলোভন দিয়ে বিমান পাঠিয়ে তাকে দিল্লিতে নিয়ে কাশ্মীরের ভারত অন্তর্ভুক্তির চুক্তি স্বাক্ষর করিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে ভারত কাশ্মীরে স্থায়ী সংকট সৃষ্টি করে। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরের ভাগ্য নির্ধারণের যে প্রস্তাব গৃহীত হয়, তাতে বলা হয় যে গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরি জনগণই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে যে তারা ভারতের সঙ্গে অথবা পাকিস্তানে থাকবে অথবা স্বাধীনতা বেছে নেবে। ভারত প্রথমে জাতিসংঘের প্রস্তাব মেনে নিলেও পরে গণভোট অনুষ্ঠানের অবস্থান থেকে পিছু হটে। কারণ ভারতের আশঙ্কা ছিল যে গণভোটে কাশ্মীরিরা হয় পাকিস্তানের পক্ষে অথবা স্বাধীনতার পক্ষে রায় দেবে। অন্যদিকে পাকিস্তান সব সময় জাতিসংঘের প্রস্তাবিত গণভোটের পক্ষে বলে আসছে। কাশ্মীরের ভারতবিরোধী অবস্থান ও আন্দোলনের কারণে এবং নব্বই দশকের শুরু থেকে তা সশস্ত্র আন্দোলনের রূপ ধারণ করলে ভারত অধীকৃত কাশ্মীরকে এক উন্মুক্ত কারাগারে পরিণত করেছে। সেখানে গত সাড়ে তিন দশক থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনীর পাঁচ লক্ষাধিক সশস্ত্র জনবল কাশ্মীরিদের কার্যত জিম্মি করে রেখেছে। এখন ভারত নিজেই নিজেদের অপকৌশলের ফাঁদে আটকা পড়েছে। যখনই ভারতের যে কোনো দলের সরকার সংকটে পড়েছে, তখন কাশ্মীরে নৈরাজ্য ও নাশকতার পরিবেশ সৃষ্টি করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলে ভারতের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে বিভ্রান্ত করেছে। পেহেলগামে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও অনুরূপ বিজেপি সরকার সৃষ্ট অপপ্রয়াস মাত্র।
তবে ভারতে যখনই যে সরকার এসেছে, তা কংগ্রেস হোক অথবা বিজেপি, তারা তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট থেকে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে নেওয়ার জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের দামামা বাজানোর কৌশল গ্রহণ করে। এর সঙ্গে রয়েছে ভারতের আধিপত্য বিস্তার ও সম্প্রসারণবাদী নীতির যোগসূত্র এবং প্রতিটি প্রতিবেশীর সঙ্গে ‘বিগ ব্রাদার’সুলভ আচরণের মনোভাব। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ছোট বা দুর্বল কোনো রাষ্ট্রও তার স্বাধীন-সার্বভৌম অস্তিত্বকে কোনো বড় ও শক্তিশালী প্রতিবেশীর হাতে সঁপে দিতে পারে না, ভারত এই সত্য স্বীকার করতে চায় না বলেই প্রায় প্রতিটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের প্রায় স্থায়ী সন্দিগ্ধ ও বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজ করছে। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের চিরশত্রুতামূলক সম্পর্কের কথা বাদ দিলেও বাংলাদেশ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারতের যে সম্পর্ক বিরাজ করছে, তা কোনোভাবেই সমমর্যাদাসম্পন্ন সৎ-প্রতিবেশীমূলক ও পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বমূলক নয়। প্রতিটি প্রতিবেশী ভারতকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে এবং বিশ্বাস করে না। কারণ ভারত আকারে বৃহৎ হওয়ার কারণে প্রতিবেশী দেশগুলোকে প্রাচীনকালের রাজাদের মতো সবার আনুগত্য আশা করে। এর ব্যতিক্রম কেবল তার আরেক বৃহৎ প্রতিবেশী চীন। ষাট দশকে শুরুতে চীনকেও টেক্কা দিতে গিয়েছিল ভারত। এক মাসের যুদ্ধে ভারতকে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে লেজ গুটিয়ে নিতে হয়েছে।
ভারতের সম্প্রসারণবাদ নীতির সূচনা করে গিয়েছেন স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহরু। চীন ভারতের অঞ্চল দখল করে রেখেছে অভিযোগ তুলে সেই অঞ্চলগুলো পুনর্দখলের জন্য তিনি গ্রহণ করেন তাঁর বিখ্যাত ‘ফরোয়ার্ড পলিসি’। তাঁর নীতি বাস্তবায়নের জন্য ১৯৬২ সালে চীনের বিরুদ্ধে ভারতের সেনাবাহিনীকে যুদ্ধে লিপ্ত করান, ভারতের জন্য যে যুদ্ধের ফলাফল ছিল অতিবিপর্যয়কর। চীনের বিরুদ্ধে পরিচালিত তার ‘ফরোয়ার্ড পলিসির’ ব্যর্থতায় ভারতের পরবর্তী সময়ের সরকারগুলো সেই পলিসিকে ব্যবহার করেছে অন্যান্য প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে। সফলও হয়েছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানের তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক সহায়তা দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সফল হয়েছে। অবশিষ্ট পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে যুদ্ধাবস্থা টিকিয়ে রাখতে সেখানকার বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে সহায়তা করছে ভারত। শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মালদ্বীপের ওপরও প্রভাব বিস্তার করে আছে। কিন্তু এ অবস্থা চিরস্থায়ী হতে পারে না। ভারতের এই আধিপত্য ও সম্প্রসারণবাদী নীতি ১৯৬২ সালে চীনের ক্ষেত্রে যেমন সফল হয়নি, অন্যান্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে তা সফল হবে, এমন ধারণা পোষণ মূর্খতা ছাড়া কিছু নয়।
চীনের ক্ষেত্রে কী ঘটেছিল, তা সংক্ষিপ্তাকারে হলেও আমাদের জানা প্রয়োজন। অস্ট্রেলীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ সাংবাদিক নেভিল ম্যাক্সওয়েল ১৯৬২ সালে সংঘটিত ভারত-চীন যুদ্ধের ওপর তাঁর লেখা ‘ইন্ডিয়া’স চায়না ওয়ার’ গ্রন্থে ভারতের দম্ভপূর্ণ ভূমিকা ও পরিণতি তুলে ধরেছেন। যুদ্ধের সময় তিনি দিল্লিতে লন্ডনের ‘দ্য টাইমস’-এর প্রতিনিধি ছিলেন। ভারত ১৯৬২ সালের যুদ্ধকে চীনের ‘বিশ্বাসঘাতকতা ও সম্প্রসারণবাদের’ সৃষ্টি বলে যে অভিযোগ করে ম্যাক্সওয়েল তা খণ্ডন করে বলেছেন, ‘এ যুদ্ধ ছিল মূলত ভারতের সৃষ্টি। ম্যাক্সওয়েল তাঁর গ্রন্থের বিষয়বস্তুর সূত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন ভারতের টপ ক্লাসিফায়েড দলিল ‘হ্যান্ডারসন ব্রুকস-ভগত রিপোর্ট’, যাতে ভারতের সামরিক বিপর্যয়ের কারণগুলো তুলে ধরা হয়েছিল।
বইটি পড়ার পূর্ব পর্যন্ত ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধ সম্পর্কে শুধু জানা ছিল যে যুদ্ধে ভারতকে পরাজিত করতে চীনকে বেগ পেতে হয়নি। যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল ভারত-চীন সীমান্তের ৬০০ মাইলজুড়ে। চীনের অগ্রাভিযানের খবরে এমন আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছিল যে ভারত সরকার আসামের চীন সীমান্তবর্তী শহরগুলো থেকে প্রশাসন ও জনগণকে নিরাপদ স্থানে হটে আসার পরামর্শ দিয়েছিল। অনেক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে ভারতীয় বাহিনী পিছু হটলে চীন একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। সরকারি হিসাবে যুদ্ধে ভারতের ১ হাজার ৩৮৩ জন সৈন্য নিহত, ১ হাজার ৪৭ জন আহত ও ১ হাজার ৬৯৬ জন নিখোঁজ হয়েছিল। কিন্তু হ্যান্ডারসন ব্রুকস-ভগত রিপোর্টে ভারতীয় পক্ষে ২ হাজারের অধিক সৈন্য নিহত এবং ৪ হাজারের অধিক সৈন্যকে চীন যুদ্ধবন্দি করেছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া ১৫ হাজার সৈন্যের একটি ডিভিশনকে অপমানজনকভাবে পিছু হটতে হয়েছিল।
ইন্ডিয়া’স চায়না ওয়ার গ্রন্থে দুই দেশের মধ্যে ২ হাজার মাইলের অধিক অচিহ্নিত সীমান্ত নিয়ে বিরোধের বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। ভারত বরাবর দাবি করছে, উভয় দেশের সীমান্ত হচ্ছে ১৯১৪ সালে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের চিহ্নিত ‘ম্যাকমোহন লাইন’ এবং চীন তা অতিক্রম করে লাদাখ এলাকায় ৪৩ হাজার বর্গকিলোমিটারের বেশি ভারতীয় ভূখণ্ড দখল করে রেখেছে। চীন কখনো ম্যাকমোহন লাইনকে দুই দেশের সীমান্ত হিসেবে গ্রহণ করেনি। ১৯৫৯ সাল থেকে চীন ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত হিসেবে গ্রহণ করে ‘লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল’কে। জওহর লাল নেহরুর ‘ফরওয়ার্ড পলিসি’ অনুযায়ী ভারত ১৯৬২ সালে ম্যাকমোহন লাইন পর্যন্ত যত দূর সম্ভব এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে দুই দেশের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু হয় ২০ অক্টোবর এবং ২১ নভেম্বর পর্যন্ত মাসব্যাপী যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী পিছু হটে।
ভারত চীনের এ হামলাকে তাদের পিঠে ছুরিকাঘাত বলে বর্ণনা করে। চীনের ব্যাখ্যা ছিল তাদের ভূখণ্ডে ভারতের প্রবেশ ঠেকাতে পাল্টা হামলা চালাতে হয়েছে। ম্যাক্সওয়েল তাঁর গ্রন্থে তুলে ধরেছেন, ভারত কীভাবে চীনকে যুদ্ধে প্ররোচিত করেছিল। হ্যান্ডারসন ব্রুকস-ভগত রিপোর্টে চীনের বিরুদ্ধে ভারতীয় অভিযানের চুলচেরা মূল্যায়ন করতে গিয়ে সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণে ব্যর্থতার কারণে মুখ্যত রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দায়ী করা হয়েছে। নেহরু সরকারের উচ্চাভিলাষী ‘ফরোয়ার্ড পলিসি’ বাস্তবায়নের নামে নতুন ভূখণ্ড অধিকার ও চীনের সৈন্যদের সেসব এলাকা থেকে উচ্ছেদ করার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সামনে ঠেলে দেওয়ার পরিণতি বিশ্লেষণ করা হয়েছে রিপোর্টে। ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব চেয়েছিল চীন-ভারত সীমান্তে বিরাজমান অবস্থা রাতারাতি পাল্টে দিতে। কিন্তু সামরিক বাহিনীর নীতিনির্ধারকরা রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সতর্ক করেছিলেন চীনকে কোনোভাবে উসকানি দিয়ে সর্বনাশ ডেকে না আনতে। সীমান্তে নিয়োজিত সেনাধ্যক্ষরাও সরকারকে সতর্ক করেছেন। কিন্তু নেহরু সেনাবাহিনীর ওপর তাঁর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছেন, যার ফলাফল ছিল পরাজয়। ম্যাক্সওয়েল জোর দিয়ে বলেছেন, ১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীন নয়, আক্রমণকারী ছিল ভারত। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর থেকেই ভারত আন্তর্জাতিক রীতিনীতি উপেক্ষা করে একতরফাভাবে সীমান্ত নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেয়। নেহরু ও তাঁর সহযোগীরা চীনের সঙ্গে আলোচনা করার কোনো প্রয়োজন আছে বলে বিবেচনা না করে নিজেরাই মানচিত্রে তাদের চূড়ান্ত আন্তর্জাতিক সীমান্ত নির্ধারণ করেন, যা চীন মানতে পারেনি।
হ্যান্ডারসন ব্রুক-ভগত রিপোর্টে ভারতের সামরিক বিপর্যয়ের জন্য প্রতিরক্ষামন্ত্রী কৃষ্ণ মেনন, ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর ডাইরেক্টর বিএম মল্লিক, ওই এলাকায় যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী চিফ অব জেনারেল স্টাফ লে. জেনারেল বিএম কাউল, পররাষ্ট্র সচিব এমজে দেশাই, ডাইরেক্টর মিলিটারি অপারেশনস ডিকে পালিতকে দায়ী করা হলেও প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহরু ও সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল পিএন থাপারের ভূমিকা সম্পর্কে নীরবতা পালন করা হয়েছে। চীন যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করার এক দিন পর জেনারেল থাপার পদত্যাগ করেন। কিছুদিন পর জেনারেল বিএম কাউলও পদত্যাগ করেন। নেহরু তাঁর ফরোয়ার্ড পলিসির কৌশলগত ভুল উপলব্ধি করে অনুশোচনার মধ্যে ছিলেন। চীনের কাছে পরাজয়ের দুই বছর পর ১৯৬৪ সালে তিনি ভগ্নহৃদয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব চীনের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল, পরাজয়ে তারাই দোষারোপের স্বীকার হবে, এটা নতুন কিছু নয়। মাও জে দং (মাও সে তুং) ভারতকে উচিত শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন এবং তাতে তিনি সফল হয়েছিলেন। নেহরুর ফরোয়ার্ড পলিসির বাস্তবায়নে চীন কোনো প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করবে না ভেবে তিনি রাজনৈতিক আত্মতুষ্টির মধ্যে মগ্ন ছিলেন।
চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী লে. জেনারেল বিএম কাউল সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করার পর ‘দ্য আনটোল্ড স্টোরি’ নামে যে গ্রন্থ রচনা করেন, সেটিতে তিনি পরাজয়ের জন্য তাঁকে যে ঢালাওভাবে দোষারোপ করা হয় তা খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন, স্বাধীনতার পর সেনাবাহিনীকে রাজনীতিকরণের চেষ্টা শুরু হয়েছিল।
নেহরুর মৃত্যুর ছয় দশক পরও ভারতের সম্প্রসারণ ও আধিপত্যবাদী নীতির অবসান ঘটেনি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের যুদ্ধের হুংকার নেহরুর রেখে যাওয়া তথাকথিত ফরোয়ার্ড পলিসির নতুন রূপ মাত্র। এ হুংকার বাস্তবায়নের পরিবর্তে বড় দেশ হিসেবে ভারত যদি সংযমের পরিচয় দেয়, তাহলে দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান উত্তেজনা প্রশমন হওয়ার পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তির সুবাতাস প্রবাহিত হওয়ার সূচনা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ভারতের দায়িত্বই সবচেয়ে বেশি।
লেখক : নিউইয়র্কপ্রবাসী, সিনিয়র সাংবাদিক