সম্প্রতি শেষ হয়েছে ইনভেস্টমেন্ট সামিট। এতে অংশগ্রহণকারী বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ঢাকা ছাড়ার প্রাক্কালে বাংলাদেশকে বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তবে তারা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে। এ ছাড়া ইউটিলিটি সার্ভিস ব্যবস্থার উন্নতি, রাজস্ব ও ব্যাংকিং সিস্টেম সহজীকরণ, করকাঠামো সহনশীল করাসহ লাল ফিতার দৌরাত্ম্য নিয়ে তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তবে এসব বিষয়ে বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করেছেন বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন দৌরাত্ম্য কমানোর।
জানা গেছে, সামিট শেষ হলেও বিনিয়োগের সফর শেষ হয়নি। আগামী মাসে চীন থেকে ২০০ জনের একটি ব্যবসায়িক প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে আসবে। যুক্তরাজ্য, জাপান, কোরিয়ার প্রতিনিধিদলও পর্যায়ক্রমে দেশে আসবে বিনিয়োগ সংক্রান্ত দ্বিপক্ষীয় আলোচনার জন্য। তারা বিনিয়োগ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করবে। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরবের কোম্পানি ‘সারি’-এর সঙ্গে একীভূত হয়ে নতুন কোম্পানি গঠন করেছে বাংলাদেশের বি-টু-বি স্টার্টআপ কোম্পানি ‘শপআপ’। নতুন এ কোম্পানির নাম দেওয়া হয়েছে ‘সিল্ক’ গ্রুপ। নতুন গ্রুপ গঠনের পরপরই ১১০ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ পেয়েছে ‘শপআপ’। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন রিনিউয়েবল এনার্জি, সার্ভিস খাত, আইসিটিসহ ম্যানুফেকচারিংয়ের জন্য বাংলাদেশকে একটি হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন বিদেশি বিনিয়োগ। যার দ্বার উন্মোচনের পথেই হাঁটছে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় বাধা হলো দুর্নীতি আর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। এই দুটি বাধা কাটাতে পারলে বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব। বিডা জানিয়েছে, মিরসরাইয়ের ন্যাশনাল ইকোনমিক জোন বিনিয়োগকারীদের জন্য সবচেয়ে পছন্দের জায়গা। কেননা সেখানকার অবকাঠামো, যোগাযোগ, ইউটিলিটি সার্ভিস সহজতর করা হয়েছে। এ ছাড়া সেখান থেকে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর এবং মোংলা সমুদ্র বন্দর বেশ কাছে। যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারে বলে মনে করে সরকার। এজন্য এসব স্থান বিনিয়োগকারীদের পরিদর্শন করানো হয়েছে। একই সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (বিএসইজেড) পরিদর্শন করানো হয়েছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচারের তকমা নিয়ে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর পুরোপুরি বদলে যায় দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। এরপর মাত্র আট মাসের মাথায় ইনভেস্টমেন্ট সামিট করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। দেশের ইকোনমিক জোন, এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনসহ দেশের সামগ্রিক বিনিয়োগ পরিবেশ পরিদর্শন করিয়েছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের। শুধু তাই নয় এমন রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও এই সামিটে বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, ইউএইসহ রেকর্ডসংখ্যক ৪০টি দেশের খ্যাতনামা বিনিয়োগকারীরা অংশ নিয়েছেন। একই সঙ্গে বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড ইন্ডিটেক্স গ্রুপ, ডিপি ওয়ার্ল্ড, জিওডারনো ও এক্সিলারের এনার্জিসহ বিভিন্ন কোম্পানি এই সামিটে অংশ নেয়।
কোরিয়ান ইপিজেডের প্রতিষ্ঠাতা কিহাক সাং বলেছেন, সঠিক কৌশল ও সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বে পোশাক রপ্তানিতে এক নম্বর স্থানে উঠতে পারে। শুধু তৈরি পোশাকই নয়- ওষুধ, চামড়া ও সফটওয়্যার শিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে এখানে। তবে এর জন্য দরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির শীর্ষ নেতারা বিনিয়োগ সম্মেলনে অংশ নিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে বলে আশ্বস্ত করেছেন। এর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা কেটে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, বৈশ্বিক বরেণ্য ব্যক্তি হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ইমেজকে কাজে লাগিয়ে দেশটাকে নতুন করে ব্র্যান্ডিং করতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার। বিনিয়োগ সম্মেলনটি শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে। বিনিয়োগকারীদের অনেকেই মনে করেন বাংলাদেশে বিনিয়োগের মোটেও পরিবেশ নেই। তাদের এই মনে করার পেছনে যৌক্তিক কারণও রয়েছে। অতীতের সরকারের আমলে অনেক বিনিয়োগকারী এদেশে বিনিয়োগের ইচ্ছা নিয়ে এলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং নানা হয়রানি ও অসহযোগিতার কারণে ফিরে গেছেন। এখন সেই পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। সেটা বিনিয়োগকারীরা নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করে গেছেন। আগামী ১০-১৫ বছর পর এ সম্মেলনের ফলাফল পাওয়া যাবে বলেও মনে করেন তিনি।