সাংবাদিকতা সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, চাকরি স্থায়ীকরণের শুরুতে সাংবাদিকের বেতন বিসিএস ক্যাডারদের সমান করাসহ ২০টি সুপারিশ করেছে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন। একই সঙ্গে সাংবাদিকদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক করতে বলা হয়েছে। গতকাল দুপুর ১২টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে কমিশন রিপোর্ট হস্তান্তর করে।
এদিকে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের কাছ থেকে প্রাপ্ত সংস্কার প্রস্তাবগুলোর মধ্যে যেগুলো এখনই বাস্তবায়নযোগ্য সেগুলো অনতিবিলম্বে কার্যকর করার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার উদ্যোগ নেবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন হস্তান্তরকালে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি চাইব সংস্কার কমিশন আশু করণীয় বা দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়ন করা যায় এমন সুপারিশগুলো দ্রুত আলাদাভাবে আমাদের কাছে পেশ করুক।’
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কামাল আহমেদের নেতৃত্বাধীন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের এই কাজকে অমূল্য হিসেবে অভিহিত করে এই প্রতিবেদন যেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থীসহ অন্যান্যরা পড়তে পারে সে লক্ষ্যে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন। বিদেশ থেকে বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো দেখা যায় না, কমিশনের পক্ষ থেকে এমন তথ্য পাওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো যাতে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা এবং আগ্রহী বিদেশিরা দেখতে পারেন, সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে সরকার।’ পরে যমুনার সামনে সংবাদ ব্রিফিংয়ে প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন কমিশনপ্রধান কামাল আহমেদ। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এবং গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। গণমাধ্যমকে স্বাধীন, শক্তিশালী ও বস্তুনিষ্ঠ করতে প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাব করার লক্ষ্যে গত ১৮ নভেম্বর গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন গঠন করে সরকার।
কামাল আহমেদ বলেন, কমিশন ২০টি সুপারিশ দিয়েছে। এর মধ্যে সাংবাদিকতায় সুরক্ষায় আইন করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তারা সুরক্ষা অধ্যাদেশের একটি খসড়াও তৈরি করে দিয়েছেন। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো চিহ্নিত ও পর্যালোচনা করার কথা বলেছেন তারা। মিথ্যা মামলার প্রমাণ পেলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে, ক্ষতিগ্রস্ত সাংবাদিক ও তার পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা এবং ক্ষতিগ্রস্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানকে যৌক্তিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
তিনি বলেন, সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়েও সুপারিশ করেছে কমিশন। এ ক্ষেত্রে সাংবাদিকতায় প্রবেশের শুরুতে বেতন বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসে প্রবেশপদ, অর্থাৎ নবম গ্রেডের বেতন স্কেলের সঙ্গে সংগতি রাখা যেতে পারে। সারা দেশের সাংবাদিকদের জন্য এটি হতে পারে।
জীবনযাত্রার ব্যয় বেশি হওয়ায় ঢাকার সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে ‘ঢাকা ভাতা’ যোগ করা যেতে পারে, যা ঠিক করবে সরকার ও সংবাদমাধ্যমের বিভিন্ন পক্ষ মিলে। তবে এই বেতন পেতে এক বছর শিক্ষানবিশকাল অতিক্রম করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কী হবে জানতে চাইলে কামাল আহমেদ বলেন, শুধু সাংবাদিক নয়, সম্পাদক ও প্রকাশকের যোগ্যতা কী হবে, সেই তিনটি বিষয়ও রাখা হয়েছে প্রতিবেদনে। সাংবাদিকদের ন্যূনতম যোগ্যতা স্নাতক থাকতে হবে।
কমিশনের সুপারিশমালায় ছোট আকারের মিডিয়া কোম্পানিতে কর্মীদের শেয়ার দেওয়া বাধ্যতামূলক করা, একই ব্যক্তি/গোষ্ঠী/প্রতিষ্ঠান/কোম্পানি/পরিবারের একই সঙ্গে পত্রিকা ও টেলিভিশনের মালিকানা না থাকা; সব ধরনের গণমাধ্যমকে একই তদারকি সংস্থার আওতায় আনতে বাংলাদেশ গণমাধ্যম কমিশন গঠন করা; সাংবাদিকতা সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা; সাংবাদিকতার স্বাধীনতার জন্য সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ, ফৌজদারি মানহানির সব আইন, সাইবার নিরাপত্তা আইন, অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, আদালত অবমাননা আইন, বিদ্বেষমূলক বক্তব্য আইন, তথ্য অধিকার আইনসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আইনের সংস্কার করা; বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের লাইসেন্স প্রদান প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করা, টিআরপি ব্যবস্থার অনিয়ম দূর করা; অনলাইন পোর্টালে শৃঙ্খলা আনতে এর নীতিমালা পর্যালোচনা করে কার্যোপযোগী করা; বিটিভি, বেতার ও বাসসের সমন্বয়ে বাংলাদেশ সম্প্রচার সংস্থা বা জাতীয় সম্প্রচার সংস্থা নামে নতুন প্রতিষ্ঠান গঠন করা; ভুয়া প্রচারসংখ্যা দেখিয়ে সরকারি বিজ্ঞাপন নেওয়া বন্ধ করতে সংবাদপত্রের প্রচারসংখ্যা নিরীক্ষার জরুরি সংস্কার করা, পত্রিকার বিজ্ঞাপনের হার বাড়ানো; বিজ্ঞাপনের মান ও বিজ্ঞাপন বণ্টনে স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা ও প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে তদারকি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা; সাংবাদিকদের আর্থিক ও কর্মস্থলে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা ও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিয়মিত বেতন বৃদ্ধি, গণমাধ্যমে জেন্ডার সমতা নিশ্চিতসহ বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়েছে।