চলচ্চিত্র অঙ্গনের সবচেয়ে বড় পুরস্কার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। প্রতি বছর ২৮টি ক্যাটাগরিতে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়; কিন্তু ২০২১ সালে একটি কমে ২৭ ক্যাটাগরিতে ৩৪টি পুরস্কার দেওয়া হয়। কারণ ‘শ্রেষ্ঠ নৃত্য পরিচালক’ ক্যাটাগরিতে কোনো প্রার্থী যোগ্য বিবেচিত হয়নি। নৃত্য-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলচ্চিত্রের নাচের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের মুনশিয়ানার অভাবে এমন একটি দুঃখজনক চিত্র আবারও দেখা গেল। এর আগেও বেশ কয়েক বছর এ অনাকাক্সিক্ষত ফল দেখতে হয়েছে। ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত জাতীয় পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ নৃত্যশিল্পী বিভাগে কেউ যোগ্যতা দেখাতে পারিনি বলে এ বছরগুলোতে জাতীয় পুরস্কার বঞ্চিত হয়েছে চলচ্চিত্রের নৃত্য ক্যাটাগরি। নাচের অবস্থা এখন অন্তঃসারশূন্য। এ ক্ষোভ জানিয়ে নৃত্যগুরুরা বলছেন, বর্তমানে চলচ্চিত্রের নাচ মানে হাত-পা ছোড়াছুড়ি আর শরীর দোলানো মাত্র। যদিও বেশ কিছু ডান্স গ্রুপ যুক্ত হয়েছে চলচ্চিত্রে। তবু অবস্থার উন্নতি নেই। এ অবস্থা থেকে কীভাবে পরিত্রাণ সম্ভব। এ ব্যাপারে কয়েকজন নৃত্য ব্যক্তিত্বের পরামর্শ এখানে তুলে ধরা হলো-
নৃত্য নিয়ে গবেষণা করতে হবে : ইমদাদুল হক খোকন
চলচ্চিত্রের নৃত্যের মান কমেছে সত্যি। এর জন্য নৃত্য পরিচালক বা শিল্পীরা দায়ী নন। আগে গানের কথা আর সুরের কারণে নৃত্যের কম্পোজিশন করা খুবই সহযোগী ছিল। আর এখন গানের কথা ও সুরের মন্দের কারণে কম্পোজিশন করতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হয়। গানের কথা ও সুরে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মান থাকে না। তা ছাড়া এখনকার নির্মাতারা নাচের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সময় দিতে নারাজ। ফলে তাড়াহুড়া করে দায়সারা গোছের কাজ করতে গিয়ে চলচ্চিত্রের নৃত্যের মান বলে কিছুই থাকছে না। এখনকার নির্মাতাদের মধ্যে বেশির ভাগেরই নাচ সম্পর্কে কোনো জ্ঞান নেই। নাচ হচ্ছে অন্যতম প্রধান বিনোদন। ছবি হয়তো দর্শক একবার দেখে। কিন্তু টিভিতে গান বারবার প্রচার হয়। মানে ছবির চেয়ে নাচ বেশি প্রদর্শন হয়। তাই নাচের প্রতি যত্নবান হওয়া জরুরি। এক কথায় নাচের ব্যাপারে নির্মাতাদের সচেতন ও মনোযোগী হতে হবে। নৃত্য নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করতে হবে।
নির্মাতাদের সচেতন হতে হবে : মুনমুন আহমেদ
চলচ্চিত্রে বেশ কিছুদিন ধরে যারা নাচের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদের বেশির ভাগেরই নাচ সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান বা প্রশিক্ষণ নেই। ফলে চলচ্চিত্রের নাচ প্রতিনিয়ত প্রশ্নের মুখে পড়ছে। যে কোনো কাজ যথার্থভাবে পেতে গেলে অভিজ্ঞদের দিয়ে করানো প্রয়োজন। না হলে মান নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। চলচ্চিত্রের নাচের ক্ষেত্রে উপযুক্ত বাজেটেরও অভাব আছে। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকে কোনোভাবে অবহেলা করার সুযোগ নেই। অথচ চলচ্চিত্রের নাচের ক্ষেত্রে তাই হচ্ছে। চলচ্চিত্রের নির্মাতাদেরও নাচ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান থাকতে হবে। একই সঙ্গে প্রশিক্ষণ, অনুশীলন, চর্চা এবং স্কুলিংয়ের বিকল্প নেই। চলচ্চিত্রের নাচকে যথাযথ করতে হলে এসব বিষয়ে নির্মাতাদের সচেতন হতে হবে।
শিল্প মনে করা হয় না নাচকে : শিবলী মহম্মদ
নৃত্যের বিষয়টিকে চলচ্চিত্রকাররা কতটা গুরুত্ব দেন সে ব্যাপারে আমার মনে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তারা যদি বিষয়টিকে সত্যিই ফিল করতেন তাহলে সৃজনশীল নাচের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের নিয়ে কাজ করতেন। এখন তো সময়োপযোগী নাচই হচ্ছে না। ফলে এ নাচ আর গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না। শিল্পীদের মধ্যেও বেশির ভাগেরই নাচ সম্পর্কে কোনো জ্ঞান নেই। ফলে চলচ্চিত্রের নাচ কোনোভাবেই প্রাণ পাচ্ছে না। বলিউড অভিনেত্রী রেখা ‘ওমরাহ জান’ ছবির জন্য ছয় মাস নাচের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ‘দেবদাস’-এর জন্য মাধুরী এক বছরেরও বেশি সময় নাচ শিখেছেন। ভারতের ঐতিহাসিক ছবিগুলোতে নৃত্যগুরুদের দিয়ে কাজ করানো হয়। এখানে তা নেই। তাই সৃজনশীলতার অভাব সব সময়ই চোখে পড়ে। এখন চলচ্চিত্রের নাচ হচ্ছে করার জন্য করা। সত্যিকার অর্থে কোনো শিল্প মনে করা হয় না নাচকে। চলচ্চিত্রের নাচকে শিল্পমানে উন্নীত করার চেষ্টা কারও মধ্যে দেখি না। যা সত্যিই দুঃখজনক।
নাচের মৌলিকত্ব চাই : শামীম আরা নীপা
চলচ্চিত্রের নাচ এখন আর আগের মতো নেই। কারণ এখন আর কেউ জেনে-বুঝে নৃত্য পরিচালনা করছে না। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা হচ্ছে, নাচের মৌলিকত্ব বলতে কিছুই নেই এখন। কপিপেস্ট চলছে শুধু। মানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভারতীয় চলচ্চিত্রের নাচকে নকল করা হচ্ছে। যোগ্যতার অভাবে কপি করতে গিয়ে তাও হচ্ছে না। একসময় গওহর জামিল, জি এম মান্নানদের মতো নৃত্যগুরুরা চলচ্চিত্রের নাচের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ফলে সত্যিকারের নাচ পাওয়া যেত। এখন তো প্রপার ডান্সারদের চলচ্চিত্রে ডাকা হয় না। ফলে চলচ্চিত্রের নাচের কোনো উন্নতি হচ্ছে না। যারা আছেন তারা কপি করা নাচের মাধ্যমে কেবল গ্লামার দেখাতে চান, মৌলিকত্ব নয়। বিষয়টি দুঃখজনক। চলচ্চিত্রের নাচকে উন্নত করতে প্রশিক্ষণ, চর্চা, সময় দেওয়া, সত্যিকারের নৃত্যশিল্পীদের দিয়ে নাচ করানোসহ এক্ষেত্রে অভিনয় শিল্পীদেরও নাচ সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করতে হবে।