আঁধার যখন আলোকে ঢেকে ফেলে, তখন অন্ধকারে ছেয়ে যায় সব। দিন আর রাতের কোনো পার্থক্য তখন আর বোঝা যায় না। রাতের আঁধারে আড়ালে আবডালে লুকিয়ে যে কাজ করতে হয়, সে কাজ যখন প্রকাশ্যে ঝলমলে দিনের আলোয় মানুষ করে, তখনই বুঝতে হবে, সবকিছু অন্ধকারের দখলে চলে গেছে। খাদ্যে বিষ মেশানো, মানুষ ঠকানো, ব্যবসার নামে ডাকাতি করা, সুদ-ঘুষ ও দুর্নীতির মহোৎসবসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যা নির্লজ্জের মতো আইনকানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এ দেশের মানুষ করছে না। আফসোস! বহু অনিয়ম এ দেশে নিয়ম হয়ে গেছে। বহু বেআইনি কাজ মানুষ আইন ভেবে করে যাচ্ছে। যুগে যুগে যখনই একটি জাতি এভাবে বেআইনকে আইন বানিয়ে নিয়েছে, আঁধারের আধিপত্য চালিয়েছে, তখনই খোদার আজাব তাদের চোখের পলকে ধ্বংস করে ফেলেছে। সুরা আরাফে আল্লাহ বান্দাকে হুঁশিয়ার করে বলছেন, ‘হে মানুষ! জেনে রাখ, অনেক অবাধ্য সীমা লঙ্ঘনকারী জাতিকে আমি ধ্বংস করে দিয়েছি। আমার আজাব তাদের ওপর হামলে পড়েছে গভীর রাতে যখন তারা নিবিড় ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল। কিংবা দুপুরের খাবারের পর যখন নিশ্চিন্তমনে তারা বিশ্রাম করছিল। যখনই আমার আজাব তারা চোখে দেখল তখন তাদের মুখ ফুটে শুধু একটি কথাই বেরিয়েছিল, হায়! আমরা তো চরম অত্যাচারী ও সীমা লঙ্ঘনকারী ছিলাম (সুরা আরাফ, আয়াত ৪-৫)।’
প্রিয় পাঠক! কোরআনের বিভিন্ন আয়াত গবেষণা করলে সহজেই বোঝা যায়, আল্লাহপাক যখন কোনো জাতিকে ধ্বংস করেন, তখন ওই জাতি এটা বলে না, আমরা খুব ভালো ছিলাম তাহলে কেন আল্লাহ আমাদের ধ্বংস করলেন? তারা এটাও বলে না, আমরা অল্পবিস্তর খারাপ কাজ করি, কিন্তু একেবারে ধ্বংস করে দেওয়ার মতো কোনো গুনাহ তো আমরা করিনি। বরং তারা সবাই এক বাক্যে বলে উঠেছে, হায়! সত্যিই আমরা বড় অত্যাচারী ছিলাম। বড় সীমা লঙ্ঘনকারী ছিলাম। আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকালেও একই দৃশ্য দেখা যাবে। প্রতিটি মানুষ এ কথা স্বীকার করছে, অন্যায়-জুলুম, দুর্নীতি, ঠগবাজিতে আমরা পৃথিবীর সব জাতিকে ছাড়িয়ে গেছি। শুধু কি তাই, দুর্নীতির কারণে পৃথিবীর সভ্য কোনো দেশ আমাদের কথা বিশ্বাস করতে চায় না। আমাদের কাগজ তারা ভুয়া বলে উড়িয়ে দেয়। কোথাও কোনো ভালো প্রস্তাব নিয়ে গেলে তারা ঠগবাজ বলে আমাদের তাড়িয়ে দেয়। এমনটা কেন হয়েছে? আমাদের জীবন-সমাজ ও রাষ্ট্র সর্বত্রই এতকাল আলোর পরিবর্তে অন্ধকারের রাজত্ব চলেছে বলে। আমাদের রাষ্ট্রনায়করা বারবার চেষ্টা করেছেন আমাদের শোধরাতে, আমরা সে সুযোগ আগেও গ্রহণ করিনি। এখনো তা কানে নিচ্ছি না। এমন জাতি তো আসলে খোদায়ি গজবেরই উপযুক্ত। আর সে কথাই কোরআনে বলা হয়েছে স্পষ্টভাবে। যেদিন আল্লাহর আজাব নেমে আসবে কালো মেঘের ঘোমটা পরে, সেদিন মানুষ চিৎকার করে বলবে, হায়! আমরা মানুষ ঠকানোতে ছিলাম বিশ্বসেরা। সেদিন মানুষ তার মুখে স্বীকার করবে সে অপরাধের সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠে গিয়েছিল। সে শাস্তির যোগ্য। এমন সময় হঠাৎ দুর্যোগ-মহামারি চলে আসবে।
একটি জাতি কখন খোদার আজাবের উপযুক্ত হয়ে পড়ে সে কথা খুব সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন আল্লাহতায়ালা। ডাক্তার যেমন উপসর্গ দেখে রোগ নির্ণয় করে, বলে দেয় রোগী আর বেশি দিন বাঁচবে না, তেমনি আল্লাহও একটি জাতির মরণব্যাধি ক্যানসারের উপসর্গ এভাবে বলছেন, ‘আমার প্রকৃতির আইনে একটি জাতি তখনই ধ্বংসের দুয়ারে এসে দাঁড়ায় যখন তারা আলো ঢেকে কালোর রাজত্ব শুরু করে। যখন তাদের প্রভাবশালীরা হয় অন্যায় কাজে সেরা। যখন সৎকাজের কোনো সামাজিক মর্যাদা মানুষ দেয় না, সৎপথে মানুষ চলে না। অন্যায়-অনাচার-দুর্নীতিতে তারা হয় চ্যাম্পিয়ন। তখন আমার আজাব তাদের পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেয়। নূহের পর এভাবে কত যে পাপাচারী জাতিকে তোমার প্রভু নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন, তার সঠিক পরিসংখ্যান শুধু তিনিই জানেন (সুরা বনি ইসরায়েলের ১৬-১৭ আয়াতের ভাব তরজমা)।’
হে পাঠক! কোরআনের আয়নায় এ জাতি সমাজকে দেখলে আপনিও বুঝতে পারবেন, আজাবের আর খুব বেশি দেরি নেই। সেই ভয়াবহ পরিণতি থেকে বাঁচতে চাইলে এখনই তওবাহ করে অন্যায়-অসৎ পথ থেকে পুরো জাতিকে ফিরে আসতে হবে। তবেই ইউনূস নবীর প্রজন্মের মতো এ প্রজন্মও বেঁচে যাবে। ইউনূস নবীর প্রজন্ম ছিল তুখোড় বেপরোয়া। বারবার আল্লাহর নবী সতর্ক করেছেন, তবু তারা নিবৃত্ত হয়নি অন্যায়-অবিচার ও ঠগবাজি থেকে। অবশেষে আল্লাহ তাদের জন্য আজাব পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন।
লেখক : প্রিন্সিপাল, সেইফ এডুকেশন ইনস্টিটিউট
পীর সাহেব, আউলিয়ানগর