বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৫৪ বছর। এ দীর্ঘ সময়ে দেশে শান্তি, সমৃদ্ধি, শৃঙ্খলা, আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক উন্নয়নে যতটা সময় ব্যয় হয়েছে, তার চেয়ে বেশি সময় নষ্ট করা হয়েছে দোসর খোঁজার কাজে। এলেম দ্বারা চোর ধরার মতো, ক্ষমতার মসনদে যেতে কাকে সিঁড়ি বানানো যায়, নিরন্তন সেই দোসরের সন্ধান। তারপর কে কার দোসর, কার বিচার করতে হবে, কার সম্পদ লুট করতে হবে, কার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করতে হবে, কাকে কী করতে হবে এসব নিয়েই সরকার, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ অধিক ব্যতিব্যস্ত। দোসর খুঁজতে খুঁজতে অর্থাৎ কে কার দোসর নয় তা চিহ্নিত করতে কম্বলের লোম বাছাই করার মতো অবস্থা আমাদের। ভূমিকা আর অপব্যবহারে একটা নেতিবাচক শব্দে পরিণত হয়েছে ‘দোসর’।
পৃথিবীর সব স্বাধীনতাযুদ্ধেই পক্ষ-বিপক্ষ থাকে। আমাদেরও ছিল। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করে আমরা স্বাধীন হয়েছি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহায়ক শক্তি ছিল পূর্ব পাকিস্তানেরই কিছু মানুষ। তারা রাজনৈতিক চিন্তায় পাকিস্তানের বিভক্তি চায়নি। কেউ ব্যক্তিগত চিন্তা-চেতনায় পাকিস্তান বিভক্তি সমর্থন করেনি। সে কারণেই এ দেশের অনেক মুসলিম লীগ নেতা শান্তি কমিটির সদস্য হয়ে পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করেছেন। আবার রাজনৈতিক চিন্তা থেকে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছে। সে কারণেই এ দলের সদস্যরা রাজাকার, আলবদর, আলশামসের সদস্য হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কাজ করেছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত সেই কলঙ্ক থেকে বের হতে পারেনি মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধাচারী ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশের মানুষের কাছে তারা এখনো রাজাকার, পাকিস্তানের দোসর হিসেবে পরিচিত। যারা রাজাকার, আলবদর, আলশামস ছিলেন তাদের অনেকেই এখন আর বেঁচে নেই। কিন্তু রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের এখনো সেই পাকিস্তানের দোসর হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়। জুলাই বিপ্লবের পরও সেই অপবাদ থেকে তারা মুক্তি পাচ্ছেন না।
শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। কিন্তু নিজ দল বিলুপ্ত করে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) নামে নতুন রাজনৈতিক ফ্রন্ট গঠন করেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এবং জাতীয় লীগ নিয়ে গঠিত হয়েছিল এ ফ্রন্ট। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বহুদলীয় সংসদীয় সরকার পদ্ধতি পরিবর্তন করে একদলীয় ও রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। দেশের সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে বাকশাল গঠন করা হয়। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যার পর ক্ষমতা দখল করেন তারই বিশ্বস্ত সহকর্মী খন্দকার মোশতাক আহমদ। তখন থেকেই রাজনীতিতে খোঁজা শুরু হয় আওয়ামী-বাকশালের দোসর। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তার, প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলেও আওয়ামী লীগের দোসর খোঁজা হয়েছে। শেখ মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা ২১ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। তার সেই সময়ে দোসররা বৈধ-অবৈধ পন্থায় দুধে ভাতে যথেষ্ট ভালো থাকলেও আওয়ামী লীগের দোসর খোঁজা এখনো শেষ হয়নি। জুলাই বিপ্লবের পর এখন আবার সাঁড়াশি অভিযানে আওয়ামী লীগের দোসর খোঁজা হচ্ছে।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দীর্ঘ নয় বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন। এ সময় আওয়ামী-বাকশালের দোসর, বিএনপির দোসর খোঁজা হয়েছে। এ নয় বছরের মধ্যে ১৯৮৬ সালে এরশাদের পাতানো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আওয়ামী লীগ। সে সময় শেখ হাসিনার সঙ্গে এরশাদের রাজনৈতিক সুসম্পর্ক থাকায় কিছুদিন আওয়ামী-বাকশালী দোসর খোঁজা বন্ধ ছিল। পরে অবশ্য আওয়ামী-বাকশালীর দোসর, বিএনপির দোসর খুঁজতে খুঁজতেই ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদের পতন হয়।
এরপর শুরু হয় এরশাদের দোসর বা জাতীয় পার্টির দোসর খোঁজা। এরশাদের দোসর বা জাতীয় পার্টির দোসরদের নিয়ে ২০০৬ সালে গঠিত হয় মহাজোট। এ জোট গঠনের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীদেরও আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আওয়ামী লীগের সঙ্গে গত ১৬ বছর জাতীয় পার্টি মহাজোটের বন্ধনে থাকায় জুলাই বিপ্লবের পর এখন জাতীয় পার্টিও আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।
স্বাধীনতার ৫৪ বছরের মধ্যে এরশাদের নয় বছর এবং হাসিনার ২১ বছর বিএনপি-জামায়াতের দোসর খোঁজা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। অবশ্য ১৯৯৬ সালে জামায়াতে ইসলামী যখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনি ঐক্য করে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাসীন করে, শুধু সেই মেয়াদে আওয়ামী লীগ জামায়াতকে প্রকাশ্যে রাজাকার বা পাকিস্তানের দোসর বলত না। বিগত ১৬ বছর শেখ হাসিনা টানা ক্ষমতায় ছিলেন। এ সময় সব ক্ষেত্রে বিএনপি-জামায়াতের দোসর খোঁজা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। রাজনীতি, ষড়যন্ত্র, জঙ্গি উত্থান, চাকরি, পদোন্নতি, ব্যবসা, বিয়েশাদি, সামাজিকতাসহ সব ক্ষেত্রেই খোঁজা হয়েছে বিএনপি-জামায়াতের দোসরদের। সেই সঙ্গে খোঁজা হয়েছে একাত্তরের চেতনাবিরোধী দোসরদের। দোসর খোঁজার রাজনীতির এ ১৬ বছর দেশে সব ক্ষেত্রেই বিভাজন তৈরি হয়। এ বিভাজনকে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ও বিপক্ষের শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টা চালায়। মুক্তিযুদ্ধ করেছেন অথচ আওয়ামী লীগ করেন না, এমন ব্যক্তিকেও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তির দিকে ঠেলে দিয়েছে। পিতা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, সন্তান ছাত্রলীগ করেনি বলে চাকরি পায়নি।
দোসর খোঁজা বিভাজন সৃষ্টির শেখ হাসিনার ১৬ বছরে নোংরা রাজনীতির শিকার হয়েছেন অনেক শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও বেসরকারি উদ্যোক্তা। সরকার নিজের স্বার্থে ব্যবহার করার জন্য ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ প্রয়োগ করত। কোনো ব্যবসায়ী সরকারের মতের বাইরে স্বতন্ত্র চিন্তা করলেই দুদক, এনবিআর আর বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে ভয়ভীতি দেখানো হতো। প্রধানমন্ত্রীর তোষামোদ অনুষ্ঠানে তোতা পাখির মতো শেখানো বক্তব্য না দিলে দেখানো হতো জঙ্গি অর্থায়ন অভিযোগে মামলার ভয়। অথবা ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে নানা ঝামেলায় ফেলার হুমকি দেওয়া হতো। কোনো কোনো ব্যবসায়ীকে মিথ্যা হত্যা মামলায় আসামি করে বছরের পর বছর শেখ হাসিনা সরকার নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছে।
দোসর খোঁজার রাজনীতির ৫৪ বছরে অনেক সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদ, ধান্দাবাজ, চাঁদাবাজেরও জন্ম হয়েছে। ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’-এ ফর্মুলায় রাজনীতিবিদরা একদল আরেকদলের ভিতরে ঢুকে গেছেন। পানির চরিত্র ধারণ করে যে দলে প্রবেশ করেছেন সে দলের রং ধারণ করেছেন। নব্বইয়ের গণ অভ্যুত্থানের পর এরশাদের দোসর হিসেবে বেশ কিছু ব্যবসায়ীকে চিহ্নিত করা হয়। কিছু রাজনীতিবিদ, কিছু ধান্দাবাজ, চাঁদাবাজ ওইসব ব্যবসায়ীকে নানাভাবে চাপে ফেলে লুটে নিয়েছিল অর্থসম্পদ। কেউ কেউ ব্যবসার ভাগও নিয়েছে। সে সময় এরশাদের দোসর হিসেবে চিহ্নিত সালমান এফ রহমানের পাসপোর্ট আটক করে অর্থ আদায়ের ঘটনা অনেকেরই জানা আছে।
জুলাই বিপ্লবের পর গত আট মাসেও সারা দেশে দোসর খোঁজার নামে ব্যবসায়ীদের চাপে ফেলে মালপানি কামানোর ধান্দায় নেমেছে একশ্রেণির ধান্দাবাজ, চাঁদাবাজ। এর মধ্যে একটা শ্রেণি আওয়ামী লীগের চিহ্নিত নেতাদের আশ্রয় দিয়ে নিরাপদে রেখে কামাচ্ছে মালপানি। ভুয়া মামলারও শেষ নেই। হত্যা মামলায় শেখ হাসিনার সঙ্গে ব্যবসায়ীদের নাম ঢুকিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত করে রাখা হচ্ছে। মামলা থেকে নাম বাদ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে দাবি করা হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। কোনো কোনো ধান্দাবাজ গোষ্ঠী ব্যবসায়ীদের বাড়িঘর বা ব্যবসায়িক স্থাপনায় হামলা করার হুমকিও দিচ্ছে। অনেক ব্যবসায়ী সম্পদ ও মানসম্মান রক্ষার স্বার্থে টাকাপয়সা দিয়ে আপসরফা করছেন। কেউ কেউ করছেন না। যারা চাঁদা দিয়ে আপসরফা করছেন না, তাদের ওপর চাঁদাবাজরাও ক্ষিপ্ত হচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানও ক্ষিপ্ত হচ্ছে।
বিগত ৫৪ বছরের দোসর খোঁজার রাজনীতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নষ্ট রাজনীতি ও নষ্ট রাজনীতিবিদের কারণেই দোসরদের জন্ম হয়। দোসর খোঁজার রাজনীতি আমাদের মধ্যে বিভাজনও সৃষ্টি করেছে। যারা দোসর সৃষ্টি করে, তারা চমৎকারভাবে ভোল পাল্টে এক পাত্র থেকে অন্য পাত্রে চলে যায়। পাতি নেতা থেকে হয়ে যায় বড় নেতা। ছোট চাঁদাবাজ থেকে হয়ে যায় বড় চাঁদাবাজ। শহরতলির ছোট্ট ভাড়া বাসা থেকে গুলশান-বনানীর মতো অভিজাত এলাকার বাসিন্দা হয়ে যায়। স্বভাবতই অনুগামী, বন্ধু-বান্ধবীর অভাব হয় না। নানা উপাচারে কিছুদিন তারা বেশ ভালোই থাকে। লোভনীয় জীবযাপন করে। তারপর প্রকৃতির নিয়মেই এসবের ফল ভোগ করতে হয়। মাশুল গুনতে হয় কড়ায় গন্ডায়। আর নষ্ট রাজনীতির দোসর হিসেবে যাদের পরিচিতি হয়ে যায়, বিপদ কখনো তাদের পিছু ছাড়ে না। সে কারণেই এখন সুযোগ ও সময় এসেছে নষ্ট রাজনীতি পরিহারের। সেই সঙ্গে ক্লিন ইমেজের রাজনৈতিক নেতাদের দলের নেতৃত্বে আসতে হবে। যে রাজনীতি লেজুড়বৃত্তি করতে হয়, দোসর সৃষ্টি হয়, সেই রাজনীতি বর্জন করতে হবে। রাজনীতি হতে হবে আদর্শভিত্তিক। রাজনীতি হতে হবে দেশ ও মানুষের কল্যাণের লক্ষ্যে। সুতরাং এখনই সময় দোসর খোঁজার রাজনীতি পরিহার করে নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে সামনে এগোনোর।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন