ঈমানি চেতনায় বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষায় স্বাগত বাংলা নববর্ষ। মহান আল্লাহ কষ্ট দেওয়ার লক্ষ্যে ও সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসের জন্য মানুষকে সৃষ্টি করেননি। বরং নিপীড়ন, পাপে পতন হতে মুক্ত হয়ে ঘুরে দাঁড়াবে মানুষ। মহান আল্লাহর রহমত প্রত্যাশার শিক্ষা দিয়ে তিনিই বলেন, ‘হে আমার বান্দারা, যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হয়ো না...।’ (সুরা : জুমার, আয়াত : ৫৩)
পবিত্র কোরআনের নির্দেশনা—‘আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না।’
(সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ৮৭)
বিশেষ ঘটনা স্মরণে মানুষ সন-তারিখ বলে; যেমন—সংগ্রামের বছর, বন্যার বছর, আকালের বছর। ‘হস্তিবর্ষ’ চালু হয় আবিসিনিয়ায় আবরাহার হস্তিবাহিনী ধ্বংস হওয়ার ফলে। ঈসা (আ.)-এর সম্মান স্মরণে খ্রিস্টাব্দ (ঈসায়ি সন)।
প্রিয় নবী (সা.)-এর হিজরতের বছর ৬২২ খ্রিস্টাব্দকে প্রথম বছর ধরে ঘটনার ১৭ বছর পর ওমর (রা.) হিজরি সন প্রবর্তন করেন। পবিত্র কোরআনে ১২ মাসে এক বছর প্রসঙ্গে আছে, ‘নভোমণ্ডল-ভূমণ্ডল সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই আল্লাহ ১২ মাস নির্ধারণ করেছেন...।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৩৬)
বর্ষপরিক্রমা প্রসঙ্গে আছে,
‘তিনি সূর্যকে প্রচণ্ড দীপ্তি দিয়ে,
চাঁদ বানিয়ে দিলেন স্নিগ্ধতা ভরে
বছর গণনা ও হিসাবের তরে।’
(কাব্যানুবাদ সুরা : ইউনুস, আয়াত : ৫)
১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক বাংলা নববর্ষে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন।
মহীশূরের শাসক টিপু সুলতান প্রিয় নবী (সা.)-এর নবুয়ত লাভের বর্ষকে সূচনা ধরে বিশেষ রীতিতে ‘মুহাম্মদি সন’ প্রবর্তন করেন। আকবরের ‘ফসলি সন’ গণনারীতিতে চট্টগ্রাম ও আরাকানে প্রচলিত হয় ‘মগি সন’। বাংলা নববর্ষের উৎসব পার্বত্য জনপদে পালিত হয়। পার্বত্য তিনটি উৎসবের আদ্যক্ষরের সমষ্টি ‘বৈসাবি’ (বৈসু, সাংগ্রাই, বিজু)। হিজরি সনের আদলে বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত হয় ‘বিলায়তি সন’, ‘আসলি সন’।
এসব গণনারীতিতে মুসলিম ঐতিহ্যের সম্পৃক্ততা স্পষ্ট। লোকভাবনায় ধ্বনিত হচ্ছে—
‘আইল নতুন বছর লইয়া নব সাজ,
কুঞ্জে ডাকে কোকিল-কেকা বনে গন্ধরাজ।’
(মৈমনসিংহগীতিকা)
বখতিয়ারের বিজয়ে হিজরি সন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেলে চান্দ্রমাসভিত্তিক বছরে ১০-১১ দিনের তারতম্যে সনের হিসাব মেলাতে সমস্যা দেখা দেয়। ‘মুসলিম ফসলি সন’ বা বঙ্গাব্দ প্রবর্তনের আগে অগ্রহায়ণ থেকে বছর গণনা হতো। ‘অগ্র’ অর্থ শুরু আর ‘হায়ণ’ অর্থ বছর। অন্য মতে, ‘অগ্র’ অর্থ শ্রেষ্ঠ আর ‘হায়ণ’ অর্থ ধান। কেননা এ সময় প্রধান ফসল আমন বা শ্রেষ্ঠ ‘হৈমন্তিক’ ধান কৃষকের ঘরে উঠত। তবে বর্ষা শেষে খাজনা আদায়কারী কর্মচারীদের অসুবিধা বিবেচনায় তা শুষ্ক মৌসুমে আদায়ের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এই পটভূমিতে হিজরি সনের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখে সম্রাট আকবরের সভাসদ আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজি একটি নতুন সৌরসন উদ্ভাবন করেন। সম্রাট আকবর ফরমান জারির মাধ্যমে এই নতুন সন গণনা করেন, যার সূচনা ধরা হয় তাঁরই মসনদে আরোহণের বছর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ, ৯৯২ মতান্তরে ৯৯৩ হিজরি সনকে। যখন আকবরের ‘ফসলি সন’ চালু হয়, তখন সুবে বাংলায় মহররমে ছিল বৈশাখ মাস। সে জন্যই নতুন সনের প্রথম মাস হয় বৈশাখ।
মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ‘ওশর’ (মুসলমানদের ফসলি কর) একটি বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যখন ফসল পাকে, তখন তা খাও এবং ফসল কাটার দিন তা থেকে আল্লাহর হক (দুঃস্থজনের হক) আদায় করো।’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ১৪১)
তিনি আরো বলেন, ‘যা আমি তোমাদের জমি থেকে উৎপাদন করেছি, তা থেকে পবিত্র (উত্তম) অংশ খরচ করো।’
(সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২৬৭)
পহেলা বৈশাখও হতে পারে আমাদের নাজাতের উপায়। যেমন—
নববর্ষকে আল্লাহর নিয়ামত মনে করে শুকরিয়া আদায়।
পহেলা বৈশাখে রাষ্ট্রীয় কর পরিশোধের অঙ্গীকার করা।
নববর্ষে দেনা-পাওনার হিসাব আপ-টু-ডেট করা।
নববর্ষে বৈষম্যবিরোধী লড়াইয়ে বিপর্যস্ত মানুষের খোঁজ-খবর নেওয়া, তাদের পাশে দাঁড়ানো।
মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে মোনাজাত—১৪৩২ বঙ্গাব্দ হোক শান্তি, সহাবস্থান ও উন্নয়নের বছর। আমিন।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন