গল্প
রাতের নীলাভ অন্ধকার যখন জানালার কাচে জমে, তখন শ্রীময়ী আর আদিলের ছোট্ট বাসাটি যেন একখণ্ড স্বর্গ। হাসি আনন্দে উল্লাসে মেতে থাকে ওরা জোড়া জোনাকির মতো।
ব্যালকনিতে মৃদু আলোর বাতি জ্বলছে। আদিলের গলা জড়িয়ে দাঁড়িয়ে শ্রীময়ী বলে,
“কী খাবে, চা না কফি?”
“চা, কিন্তু শুধু তোমার হাতে বানানো”, আদিল মৃদু হাসল।
শ্রীময়ীও হাসল। “এখানেতো আর কেউ নেই যে চা বানাবে।”
-“তোমার হাতের স্পর্শে চা তো চা থাকে না শ্রীময়ী, হয় স্বর্গীয় সুধা।” হাসল আদিল।
ওদের বিয়ের দুবছর পূর্ণ হলো। হাসি-আনন্দ-সুখে ভালোই চলছে দাম্পত্য। দুজনের পরিবারই ওদের মেনে নেবে না। তাই ওরা একাকী থাকে। যদিও বিয়ের পর কারও পরিবারের সঙ্গেই যোগাযোগ হয়নি।
সেদিনের আলোকোজ্জ্বল সকালে শ্রীময়ীর কপালে চুমু খেয়ে বের হয়েছিল আদিল। বলেছিল, “ফিরব তাড়াতাড়ি।”
কিন্তু সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলো, সে ফিরল না। ফোনেও পাওয়া গেল না। অফিসও চেনে না শ্রীময়ী, কখনো প্রয়োজন মনে করেনি চেনার। রাত গভীর হলো। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। থানায় ফোন করল। রাত কাটল নির্ঘুম।
পরদিন পুলিশ এসে যা জানাল তা ছিল খুবই ভয়ানক।
-“আপনার দেওয়া তথ্য ও ছবির লোকটি মারা গিয়েছে মিস। তাও দুই বছর আগে। একটি মর্মান্তিক রোড অ্যাক্সিডেন্টে। স্পট ডেট, নাম আদিত্য চৌধুরী আদিল। পিতা আমজাদ খান ময়মনসিংহ নিবাসী। পড়তেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। আপনার দেওয়া ফোন নম্বরটি দুবছর বন্ধ।”
শ্রীময়ী বসে পড়লেন। বিদ্রুপ হাসলেন, “আপনার সব তথ্য ঠিকই আছে অফিসার। কিন্তু আমার স্বামী কালই বের হয়েছেন ঘর থেকে। আমাদের দুবছরের সংসার। তিনি অফিসের জন্য প্রতিদিনের মতো বের হয়েছিলেন।”
-তিনি কোথায় চাকরি করতেন, কী চাকরি করতেন?
-জানি না, কখনো জিজ্ঞেস করিনি।
-অদ্ভুত। আচ্ছা তার ব্যবহার করা জামাকাপড়, খুঁটিনাটি, খাতাপত্র এসবতো আছে, তাই না।
-অবশ্যই আছে। আসুন আমার সঙ্গে।
ড্রইংরুম থেকে শোবার ঘরে নিয়ে গেল শ্রীময়ী। কিন্তু কী আশ্চর্য, কিছুই নেই। তার সবই আছে, আদিলের কিছু নেই, একটি রুমাল অথবা একটি কলমের দাগ বা তার অস্তিত্বের কোনো চিহ্ন।
-শ্রীময়ী নির্বাক হয়ে গেল। অফিসার খুবই বিরক্ত বোধ করে বললেন, -আচ্ছা আপনার পরিবারের আর কেউ নেই?
-নাহ
-আত্মীয়-স্বজন?
-সবাই ত্যাগ করেছে।
-কেন?
-আমাদের অসম প্রেম কেউ মেনে নেয়নি। আদিল মুসলিম আর আমি হিন্দু।
-আপনার পিতৃ নিবাস কলকাতায়
-জি।
-আচ্ছা মিস আমরা দুঃখিত কোনো সাহায্য করতে পারলাম না। চকবাজার পিপলস হসপিটালে আমার এক বন্ধু বসেন। খুব বড় সাইকিয়েটিস্ট। এই তার কার্ড। আশা করি সে আপনাকে সাহায্য করতে পারবে।
-আপনি আমাকে পাগল ভাবছেন অফিসার।
-আমি দুঃখিত ম্যাডাম।
সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে রাত। শ্রীময়ীর অপেক্ষার শেষ নেই। স্বামী তার ফিরবেই। আদিলের স্মৃতিগুলো ভাসছে চোখে। কী বলছে সেই অফিসার। এটা আদৌ সম্ভব?
কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব, আলমারি ভর্তি কাপড় আর টেবিল ভর্তি বইপত্রইবা গেল কোথায়। অথচ আদিল সঙ্গে কিছুই নেয়নি। নাম্বারটিইবা দুবছর যাবৎ বন্ধ কীভাবে। সবাই ভুল বলছে, নিজেকে বুঝাল শ্রীময়ী।
কিন্তু পুলিশের কথাগুলো অনবরত কানে বাজছে তার।
“আদিল মারা গেছে, তাও দুবছর আগে।”
“অসম্ভব। এ হতে পারে না।” নিজেকে বোঝানোর বৃথা চেষ্টা করল শ্রীময়ী।
কিন্তু মনে কেমন একটা অস্বস্তি গেঁথে গেল। মন কিছুতেই মানছে না। উঠে দাঁড়ালো শ্রীময়ী। এগিয়ে গেল আলমারির দিকে। নাহ, আদিলের কিছুই নেই। অথচ শ্রীময়ীর সবই আছে, আদিলের দেওয়া যত শাড়ি, যত উপহার। সেই পলাশ ফুলের শুকনো পাপড়িও আছে, যেটা আদিল বাসর রাতে দিয়েছিল।
আদিলের ডেস্কের কাছে গেল শ্রীময়ী। এখানে বসে আদিল পড়ত। লেখালেখি করত। কিন্তু টেবিলটি এখন খালি। কোনো চিহ্ন নেই আদিলের। চেয়ারে বসে রইল শ্রীময়ী। কিছুই ভাবতে পারছে না। একটা ড্রয়ার খুলে একটি ছোট ডায়েরি পেল শ্রীময়ী। আগে কখনো দেখেনি সেটা।
প্রথম পাতায় লেখা- “আদিত্য চৌধুরী আদিল, জন্ম ১৬ মে ১৯৯৯, মৃত্যু ০৮ এপ্রিল ২০২৩।”
বাকি সব পাতা খালি। কোনো কালির চিহ্ন নেই। শুধু শেষ পাতায় লেখা- “অপার্থিব সুরত, মানবিক মুখোশ।”
এসবের মানে কী। ‘অপার্থিব সুরত, মানবিক মুখোশ’ এটার অর্থইবা কী? ডায়েরিটা যদি আদিলেরই হয়, আর সে যদি মারা যায় তাহলে মৃত্যুর তারিখটি লিখলইবা কে? মৃত মানুষ কি লিখতে পারে?
আর ৮ এপ্রিল ২০২৩ এটাতো তাদের বিয়ের তারিখ।
শ্রীময়ীর মনে এক অজানা শঙ্কা দানা বাঁধতে শুরু করল। রক্ত বরফ হতে শুরু করেছে। আদিলের স্মৃতিগুলো ঝাপসা হয়ে আসছে। বারবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে-
“অপার্থিব সুরত, মানবিক মুখোশ”
-আসলে এর মানে কী?
সে কি মানুষ নয়, তবে কি শুধুই স্মৃতি আর ছায়ার প্রতিফলন?
আজকের রাতটা যেন অনেক বেশি নির্জন আর শীতল। কোথাও কোনো শব্দ নেই, শুধু শ্রীময়ীর ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া। নিস্তব্ধ গুমোট শীতলতায় ডুবে আছে ঘর। আশপাশে কেউ যেন আছে।
শ্রীময়ী টেবিলে হেলান দিয়ে বসল। চোখ বন্ধ করতেই মনে হলো সে যেন কোনো গভীর কুয়োর মধ্যে পড়ছে। কিন্তু কুয়োর কোনো তল নেই। পড়ছে আর পড়ছেই। চোখ মেলল শ্রীময়ী। সে পড়ছে না। চেয়ারেই বসে আছে। হাতে সেই ডায়েরি। কেমন একটা ভেজা গন্ধ নাকে এলো, ধূপ নাকি গোলাপ জল, নাকি আগরবাতির গন্ধ, মেলাতে পারল না শ্রীময়ী। হঠাৎ চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠল। গিটারের মোহনীয় সুর, এইতো আদিলের গিটার। যেটি কোথাও খুঁজে পায়নি সে। কে বাজাচ্ছে সেটি, তাও এত রাতে।
ভয়ে ভয়ে ড্রইংরুমের দিকে পা বাড়ালো শ্রীময়ী। সেদিক থেকে আসছে শব্দ। আলো আবছায়ায় কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে সোফার কাছে। গিটারে একমনে তুলছে সুর। নিঃশব্দে কাছে এসে দাঁড়াল শ্রীময়ী। শব্দ থেমে গেল। শরীর ঘুরিয়ে শ্রীময়ীর দিকে ফিরল ছায়াটি।
-“আদিল।” কেমন একটা গুমোট আর্তনাদ বের হলো শ্রীময়ীর কণ্ঠে। পরক্ষণে আবেগ আর অভিমানে জড়িয়ে এলো গলা। ইচ্ছা করল এখনই বুকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে নড়তে পারল না শ্রীময়ী।
-“তুমি কোথায় ছিলে?”
আদিল উত্তর দিল না। হাসলো। এক করুণ হাসি। গুমোট কোনো বেদনায় সিক্ত সে হাসি। শ্রীময়ীর চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে রইল। তার দৃষ্টি শীতল, শূন্য। তারপর মৃদু মোলায়েম স্বরে বলল,
“আমি তো এখানেই আছি, শ্রীময়ী।”
কান্নায় ভেঙে পড়ল শ্রীময়ী। “আমাকে সত্য বলো, তুমি মারা গিয়েছিলে দুবছর আগে। আমাদের বিয়ের দিন। তাহলে তুমি কে?”
-“ছায়া। ছায়া অথবা প্রতিফলন।”
-“ছায়া অথবা প্রতিফলন?” ডুকরে কেঁদে উঠলো শ্রীময়ী। “এমনটা কেন করলে আদিল?”
“জানতে চাও? তাহলে এসো আমার সঙ্গে।”
শ্রীময়ীর হাত ধরে অন্ধকারে পা বাড়াল আদিল। সেটা কোনদিকে বুঝতে পারল না শ্রীময়ী। শুধু বুঝল কোনো এক নিঝুম নিস্তব্ধ জগতে পা বাড়িয়েছে ওরা।
লাখো মানুষের কণ্ঠধ্বনি শোনা গেল। কারও উল্লাস কারও আর্তনাদ। একটি উদ্যানে এসে দাঁড়াল ওরা। না সতেজ না ধূসর সেই প্রান্তর। প্রাণহীন নাকি প্রাণবন্ত বোঝা গেল না। শুধু এটা বোঝা গেল, এটি পৃথিবীর কোনো উদ্যান নয়, এ এক অন্য জগৎ।
আদিল শুরু করল,
-“তোমার মনে আছে শ্রীময়ী, সেদিন তোমাকে নিয়ে পালানোর কথা? সবাই আমাদের খুঁজছিল, আর আমরা খুব দূরে অজানা কোনো ঠিকানায় ছুটলাম, স্বপ্নের অভিমুখে। আমরা যখন বিয়ে করতে কাজি অফিসের সামনে গেলাম, তুমি পানি খেতে চাইলে। মনে আছে।”
-“আছে, তুমি রাস্তা পার হয়ে পানি কিনতে গিয়েছিলে। আর পানি নিয়ে ফিরলে।” “না ফিরিনি। তোমার মনে নেই, একটা জটলা বেধেছিল ঠিক তোমার সামনের রাস্তায়, তুমি চিৎকার করে উঠেছিলে। একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল। তুমি আমার নাম ধরে চিৎকার করে উঠেছিলে।”
-“কিন্তু তুমি ফিরে এসেছ দেখে আমি শান্ত হলাম। তুমি বলেছিলে একটি বাস এক লোককে পিষে দিয়েছে। আমি দেখতে চাইলে তুমি বাধা দিলে।”
-“ঠিক। সেই হতভাগা আমিই ছিলাম শ্রীময়ী।”
-“তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি ফিরে এসেছিলে। আমার জন্য পানিও এনেছ। কিছুক্ষণ পর আমরা বিয়েও করেছিলাম। তুমি আমাকে কেন বিভ্রান্ত করছ আদিল।”
-“এটাই সত্যি শ্রীময়ী। আদিল নয়, আদিলের প্রতিফলনই ফিরেছিল। যাকে তুমি বিয়ে করেছ আর এখনো তোমার সামনে।”
-“এমনটা কেন করলে?”
-“মায়া ছাড়তে পারিনি, কিন্তু এখন সময় ফুরিয়ে এসেছে। আমাকে যেতে হবে এবার।”
-“কোথায়?” আঁতকে উঠল শ্রীময়ী
-“ছায়ার জগতে।” আদিলের কণ্ঠ গাঢ় হয়ে এলো, “তুমি ফিরে যাও শ্রীময়ী, আমাকে আর খুঁজো না।”
-“তুমি ছায়া হলে আমি ছায়াকেই বিয়ে করেছি। ছায়ার সঙ্গেই থাকতে চাই।”
-“এ হয় না। ছায়ার দেশে জীবিতদের স্থান নেই। ফিরে যাও, অনেক ভালো মানুষ আছে। কিছু সময় নিয়ে, কাউকে খুঁজে নিও।”
-“তোমার পথই আমার পথ, ফেরার জন্য তো আসিনি। যে সত্যির সঙ্গে সংসার করেছি অজান্তে, জেনে তাকে ছাড়বইবা কেন?”
-“ফিরে যাও শ্রীময়ী, এখানে না পাবে জীবন, না পাবে মৃত্যু।”
তাই সই!
-“তবে চল, ধর হাত।”
ছায়ার জগতে পা বাড়াল তারা। এখানে সময়ের অস্তিত্ব নেই। জন্ম নেই মৃত্যু নেই।
শ্রীময়ীর মাথায় চক্কর দিল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো ফিরে যাওয়া উচিত। কিন্তু সে এগিয়ে চলল, শ্রীময়ী এসবের মানে জানতে চায়। একটি বিশাল দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল ওরা। দরজার গায়ে লেখা-
“যে জানে, সে হারায়। যে ভুলে যায়, সে বাঁচে।”
আদিল বলল, “ওপারে গেলে ফেরার দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। তুমি কি সত্যি যেতে চাও শ্রীময়ী?”
শ্রীময়ী উত্তর দিল না। হাত বাড়িয়ে দরজায় স্পর্শ করল। হিম শীতল দরজা ধীরে ধীরে খুলে গেল।
একটি প্রশস্ত ঘর। বিশাল দেয়ালজুড়ে টাঙানো হাজারও মুখচ্ছবি। মৃদু আলোয় সেসব দেখল শ্রীময়ী। প্রতিটি মুখ আদিলের, কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন বয়স আর সময়ের। তারা সবাই তাকে একসঙ্গে বলছিল,
“তুমি আমাকে কখনোই জান না, শ্রীময়ী। আমি তোমার প্রতিটি স্মৃতির ছায়া ছিলাম, কিন্তু সত্য কখনো তোমার ছিল না।”
শ্রীময়ীর হঠাৎ মনে হলো তার অবয়ব বদলে যাচ্ছে। সে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। এটা সে নয়, অন্য কেউ। আঁতকে উঠল,
-“আদিল, কে আমি?”
আদিল হাসল। বলল, “ছায়া অথবা প্রতিফলন।”
-“আমি কি শ্রীময়ী নই?”
-“আমি তোমায় যেমন দেখতে চাই, তুমি তেমনই।” হাসল আদিল।
-“তবে কি তুমি শ্রীময়ীকে ভালোবাসনি? শ্রীময়ী একি রূপ আজ।”
বাতাস ভারী হয়ে উঠল। শ্রীময়ীর দৃষ্টি কুয়াশাচ্ছন্ন হলো। দেয়ালে টাঙানো হাজারও মুখ থেকে ভেসে এলো ফিসফিসানির শব্দ। মন ভেঙে গেল শ্রীময়ীর, এর জন্য কি তার ছায়ার পৃথিবীতে আসা। আহ পৃথিবী, সুন্দর পৃথিবী, স্বপ্নময় ভবিষ্যতের পৃথিবী। অনুশোচনা আর স্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে তার সত্তা।
“এ আমি কী করলাম? আমি কে?” শ্রীময়ী বিহ্বল হয়ে বলল।
দেয়ালের মুখগুলো হাসল। একসঙ্গে বলল,
“তুমি সেই, যে ছায়ার প্রেমে পড়েছিল। ছায়া কখনো আলোর সামনে দাঁড়ায় না, কিন্তু তার উপস্থিতি মুছেও যায় না।”
আদিলের দৃষ্টি স্থির, মুখে হাসি। তার চোখে শীতল গভীরতা, প্রশান্তি।
- “আমাকে কেন আনলে এ দুঃস্বপ্নে?”
“কারণ ছায়া কখনো একা থাকে না।”
আদিল ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো। তার হাত বাড়াল শ্রীময়ীর দিকে।
“তুমি চাইলেও আর ফিরে যেতে পারবে না শ্রীময়ী। ছায়ার পৃথিবীতে মৃত্যু নেই, শেষ নেই। শুধু প্রতিফলনই এখানে সত্য।
-“কিন্তু আমি মৃত নই আদিল। আমি এখনো বেঁচে আছি। পৃথিবী এখনো আমাকে বিদায় দেয়নি।”
-তখনই ছায়ার একটি দরজা খুলে গেল। ওপাশে সুন্দর পৃথিবী, এপাশে ছায়ার অন্ধকার। একদিকে বাস্তবের জগৎ, সুন্দর মায়াবী পৃথিবী-কিন্তু সেখানে আদিল নেই, শুধু শূন্যতা। অন্যদিকে ছায়ার জগৎ-অভিশপ্ত অন্ধকার। কিন্তু আছে আদিলের প্রতিফলন।
দরজায় লেখা ফুটে উঠল,
-জ্ঞানীদের জন্য বাস্তব পৃথিবী, মূর্খরা ছায়ায় আটকে থাকে।
আদিল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “এটাই শেষ দরজা, শেষ সুযোগ। পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার।”
শ্রীময়ী দরজার দিকে এগুলো। কিন্তু পারল না। ফিরে এসে শক্ত করে ধরল আদিলের হাত।
“তুমি ছাড়া পৃথিবীও সুন্দর নয়। তোমার ছায়ায়, ছায়ার জগৎও ভালো। ছায়া হয়েই না হয় থাকব।”
সময়হীন জগতে সময়ের শিকলে বন্দিত্ব মেনে নিল শ্রীময়ী। স্মৃতি আর বিস্মৃতির মায়াজালে আটকে গেল সে-ও।
“তুমি কখনো মৃত্যুকে জানবে না, কিন্তু জীবনও তোমার থাকবে না। চিরকাল সময়ের জালে বন্দি থাকবে”
শ্রীময়ীর চোখে জল এলো, তোমাকে না হয় না পেলাম, ছায়াতো পেয়েছি, ছায়ার ছায়া হয়ে রয়ে যাব।
দরজা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল। শ্রীময়ী আর আদিল মিলেমিশে এক হয়ে গেল সেই জগতে, যেখানে সময়ের কোনো মানে নেই। তারা হারিয়ে গেল ছায়াপথের সেই প্রান্তে, যেখানে ভালোবাসা আর স্মৃতি এক অবিনশ্বর বৃত্ত তৈরি করে চলে অনন্তকাল।
আর পৃথিবীর বাস্তব জগতে? সেখানে শুধু রয়ে গেল একটি পুরনো, ধুলোমাখা ঘর। গিটারটা কখনো বাজে না। হয়তো বাজে, অন্তরালে- গভীর রাতে, নির্জনতা কাঁপিয়ে দিয়ে। হয়তোবা সুরের ভিতর গুমরে ওঠে কারও আর্তনাদ। মৃত্যুর পিপাসায় চিৎকার করে ছায়াপথের অন্তর্হিত প্রাণ।
লেখা পাঠানোর ইমেইল ঠিকানা