দরজায় কড়া নাড়ছে পহেলা বৈশাখ। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সর্বজনীন বাঙালির প্রাণের উৎসব। পুরোনো দিনের সব ব্যর্থতা, না পাওয়া ও গ্লানি মুছে ফেলে নতুন দিনে সমৃদ্ধি ও সফলতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে হালখাতায় দেনা-পাওনার হিসাব চুকিয়ে পুরোনো বছর বঙ্গাব্দ ১৪৩১ বিদায় জানিয়ে বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ বরণে প্রাণের বাংলাদেশ মেতে উঠবে বর্ণিল উৎসবে।
পহেলা বৈশাখ উদযাপন উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছোট কিংবা বড় মেলাসহ নানান উৎসব-অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। আর এসব অনুষ্ঠানকে ঘিরে বেড়ে যায় দেশীয় ঐতিহ্যের বাহক — নলের বাঁশির চাহিদা।
বাংলা নববর্ষকে ঘিরে নওগাঁ সদর উপজেলার তিলকপুর ইউনিয়নের দেবীপুর গ্রামের বাঁশি তৈরির কারিগররা বেশ ব্যস্ত সময় পার করছেন। গ্রামটি সবার কাছে ‘বাঁশির গ্রাম’ হিসেবে পরিচিত।
সরেজমিনে দেখা যায়, গ্রামে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে রাস্তার দুই পাশে সারি সারি বাঁশির কাঁচামাল নল গাছ। প্রতিটি বাড়ির বারান্দা, আঙিনা ও খোলা জায়গায় গাছের ছায়ায় নারী-পুরুষ সকলে মিলে ব্যস্ত বাঁশি তৈরির কাজে। কেউ নল গাছ কাটছেন, কেউ সেটিকে বিভিন্ন আকারে কেটে নিচ্ছেন, আবার কেউ বাঁশিতে রঙিন জরি ও বেলুন লাগাচ্ছেন। এভাবেই তৈরি হচ্ছে শিশুর প্রিয় খেলার সঙ্গী নলের বাঁশি।
গ্রামের প্রায় ৩০০টি পরিবার সরাসরি যুক্ত বাঁশি তৈরির সঙ্গে। বিশেষ করে বৈশাখ মাসে দেশের নানা স্থানে বসা মেলাগুলোর জন্য চলে জোর প্রস্তুতি। বাঁশি ছাড়া এসব মেলা যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাই কাকডাকা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করে যাচ্ছেন কারিগররা। এই বাঁশি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ছড়িয়ে পড়ে দেশের নানা প্রান্তের মেলায়।
প্রায় ৫০ বছর আগে এই শিল্পের সূচনা করেছিলেন গ্রামের মৃত আলেক মন্ডল। সময়ের পরিক্রমায় তার হাতে গড়া বাঁশি আজ একটি কুটির শিল্পে রূপ নিয়েছে। বড় বড় উৎসব যেমন পহেলা বৈশাখ, রথযাত্রা, মহররম, দুর্গাপূজা এবং দুই ঈদ উপলক্ষে দেবীপুর গ্রামে তৈরি হয় প্রায় ২ কোটি টাকার বাঁশি।
প্রধান কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত নল গাছ প্রক্রিয়াজাত হয়ে ১৫টি ধাপ পেরিয়ে তৈরি হয় একটি বাঁশি। একেকটি বাঁশিতে থাকে তিনটি অংশ — খাপ, চুঙ্গি ও কল। প্রতিটি সাধারণ সাদা বাঁশির উৎপাদন খরচ পড়ে ১ টাকা ৫০ পয়সা এবং পাইকারি বিক্রি হয় ২ টাকায়। রঙিন বেলুন ও জরি দিয়ে সাজালে সেই খরচ দাঁড়ায় ৫ টাকা, যা পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি হয় ৭ টাকায়। খুচরা বাজারে এই বাঁশির দাম ১৫-২০ টাকা পর্যন্ত হয়।
বাঁশি তৈরির শেষ ধাপে ১০০টি বাঁশিকে একত্রে পলিথিনে মোড়ানো হয় এবং মুখ সিল করে পাঠানো হয় দেশের নানা প্রান্তে। নলের অব্যবহৃত অংশ জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
কারিগরদের ভাষ্যমতে, এই কাজেই তারা জীবিকা নির্বাহ করছেন বহু বছর ধরে। বাচ্চু মন্ডল ও নাসিমা দম্পতি জানান, তাদের পরিবার গত ২৮ বছর ধরে এ পেশায় জড়িত। এবারের বৈশাখী মেলা উপলক্ষে ৩০ হাজার বাঁশি বিক্রি করেছেন এবং আরও ২০ হাজারের অর্ডার হাতে রয়েছে।
আলেক মন্ডলের ছেলে আনিসুর রহমান জানান, তার বাবার হাত ধরে আজ গ্রামে প্রায় ৩০০টি পরিবার এই পেশার সঙ্গে যুক্ত। বাঁশির কাঁচামাল এখন আর বাইরে থেকে আনতে হয় না, গ্রামেই উৎপাদন হয়।
এখানকার ব্যবসায়ীরা বছরে ১০ থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত বাঁশি বিক্রি করে থাকেন। বাঁশির কারিগর কোহিনুর বেগম, কমলা বানু, নাসিমা বানু ও সাজেদা বিবি জানান, নারীরাও পুরুষদের সঙ্গে সমানতালে কাজ করেন এবং সংসারের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
ছাত্র-ছাত্রী আল মাহিম ও মিলি আক্তার জানান, তারা পড়ালেখার পাশাপাশি সময় বের করে মা-বাবাকে কাজেও সাহায্য করেন।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) নওগাঁর উপ-ব্যবস্থাপক শামীম আক্তার মামুন জানান, এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে স্বল্প সুদে ঋণ এবং কারিগরি প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইবনুল আবেদীন বলেন, বাঁশির এই ঐতিহ্যকে আরও বিকশিত করতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া হবে।
দেবীপুরের বাঁশির গ্রাম তাই শুধু একটি গ্রাম নয়, এটি হয়ে উঠেছে দেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও উৎপাদনশীলতার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
বিডি প্রতিদিন/নাজিম