মহাশূন্যের অবাধ গতিপথে বড়সড় দুর্ঘটনার উপক্রম হয়েছিল। দুই ‘সুপার পাওয়ার’ চীন এবং আমেরিকার কৃত্রিম উপগ্রহ তীব্র গতিতে মুখোমুখি চলে আসায় তৈরি হয় এক ভয়ঙ্কর সংঘর্ষের পরিস্থিতি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সেই বিপদ এড়াতে নজিরবিহীন এক ঘটনা ঘটল। ইতিহাসে প্রথম বার মার্কিন মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসাকে সতর্ক করল চীনের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা সিএনএসএ। মহাশূন্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যেও বেইজিংয়ের এই ‘খেলোয়াড়োচিত’ মনোভাব আন্তর্জাতিক মহলে নতুন ভূ-রাজনৈতিক তাৎপর্য সৃষ্টি করেছে।
চলতি বছরের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক মহাকাশ সম্মেলনে নাসার পদস্থ কর্তা অ্যালভিন ড্রু এই চমকপ্রদ তথ্যটি সামনে আনেন। তিনি জানান, মহাশূন্যে তাদের নিজস্ব কৃত্রিম উপগ্রহগুলির মধ্যে সংঘর্ষ এড়াতে চীনের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল নাসার সঙ্গে। সঙ্গে সঙ্গেই সতর্ক হয়ে মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তাদের উপগ্রহের গতিপথে প্রয়োজনীয় বদল আনেন। অতীতে বহুবার নাসা চীনকে এমন বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করলেও ওয়াশিংটনের কাছে বেইজিংয়ের দিক থেকে এই ধরনের সতর্কবার্তা এই প্রথম।
একুশ শতকে বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা থেকে শুরু করে মহাকাশ গবেষণা সবক্ষেত্রেই আমেরিকা ও চীনের মধ্যে চলছে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এই আবহেও এমন সহযোগিতার ঘটনা দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা বাড়াতে সাহায্য করবে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা।
বস্তুত, পৃথিবীর নিম্নকক্ষ এখন কৃত্রিম উপগ্রহের ভিড়ে ক্রমশ ঠাসা। স্পেসএক্স-এর স্টারলিঙ্কের মতো বেসরকারি সংস্থার হাজার হাজার উপগ্রহ যেমন রয়েছে, তেমনই চীনের সিএনএসএও নতুন প্রযুক্তির খোঁজ মেলায় উৎক্ষেপণের সংখ্যা বাড়াচ্ছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে, কক্ষপথে যত উপগ্রহের সংখ্যা বাড়বে, ততই সংঘর্ষের আশঙ্কা বাড়বে।
এই সমস্যা সমাধানে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এক আন্তর্জাতিক ট্র্যাকিং কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন। ১৯৫৭ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের স্পুটনিক-১ উৎক্ষেপণের পর গত ৭০ বছরে প্রায় ৫৬ হাজার কৃত্রিম উপগ্রহ বা সমতুল বস্তু নানা কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করেছে, যার অর্ধেকই বর্তমানে পরিত্যক্ত। এই মৃত উপগ্রহের অংশ, বা নানা দুর্ঘটনার ফলে সৃষ্ট আবর্জনা পৃথিবীর নিম্নকক্ষকে ভরে তুলছে। নাসার বিজ্ঞানী ডোনাল্ড জে কেসলার ১৯৭৮ সালে তাঁর গবেষণাপত্রে এই আবর্জনার বিপদ সম্পর্কে আগেই সতর্ক করেছিলেন।
শি জিনপিংয়ের প্রস্তাব অনুযায়ী, এই আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের হাতে সমস্ত দেশের সচল ও নিষ্ক্রিয় কৃত্রিম উপগ্রহের তথ্য থাকলে আবর্জনা পরিষ্কারের কাজ অনেক সুশৃঙ্খলভাবে করা সম্ভব হবে। তবে, গুপ্তচর উপগ্রহ বা স্পেসএক্স-এর মতো বেসরকারি সংস্থার উপগ্রহের তথ্য রাষ্ট্রগুলি জানাতে চাইবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।
এই মহাকাশ সহযোগিতার ঘটনার মধ্যেই অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদক্ষেপ দেখা গিয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার বুসান শহরে রিপাবলিক অফ কোরিয়ার (আরওক) প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনা রাষ্ট্রপ্রধান শি জিনপিঙের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। এই বৈঠকের পরই ট্রাম্প তার সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্মে জি-২ শব্দটি ব্যবহার করে একটি তাৎপর্যপূর্ণ পোস্ট করেন। ট্রাম্প ইঙ্গিত দেন, চীনকে সঙ্গে নিয়ে দ্বিপাক্ষিক ভাবে বিশ্বজুড়ে মার্কিন আধিপত্য বজায় রাখতে চাইছেন তিনি। ট্রাম্প লেখেন, জি-২র বৈঠক আমাদের দুই দেশের জন্যই দুর্দান্ত ছিল।
বেইজিংয়ের বিদেশ মন্ত্রণালয় এই প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে জানিয়েছে, বিশ্বের কল্যাণের জন্য মহান ও সুনির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন করতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথভাবে দায়িত্ব পালন করতে তারা প্রস্তুত। বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন, মহাকাশে নাসা-সিএনএসএ'র মধ্যে ঘটা এই পারস্পরিক সহযোগিতাই হয়তো আগামী দিনে জি-২ গঠনের প্রক্রিয়াকে আরও দ্রুত করে তুলতে পারে। মহাকাশ গবেষণায় একদা আমেরিকার চেয়ে পিছিয়ে থাকা চীন ২১ শতকে তাদের তিয়ানগং মহাকাশ স্টেশন তৈরির মাধ্যমে যে অভূতপূর্ব উন্নতি করেছে, তাতে আন্তর্জাতিক মহলের নজর এখন এই দুই শক্তির ভবিষ্যতের দিকেই নিবদ্ধ।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল