জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেছেন, জুলাই সনদ আদেশ জারি করা হলেও জুলাই সনদ আদেশের মধ্যে এমন কিছু অস্পষ্টতা রয়ে গেছে যাতে করে জুলাই সনদের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়। গতকাল রাজধানীর বাংলামোটরে দলের অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন দলের সদস্যসচিব আখতার হোসেন, সিনিয়র যুগ্ম সদস্যসচিব ডা. তাসনিম জারা, মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী প্রমুখ।
আখতার হোসেন বলেন, আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, সরকারের জুলাই সনদে যে অস্পষ্টতার জায়গাগুলো তৈরি হয়েছে সেগুলোকে দূর করে অত্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে এবং খুবই ক্লিয়ারকাট ওয়েতে জুলাই সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে সে বিষয়গুলোকে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের মধ্যে তুলে ধরবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, জুলাই সনদ আদেশ জারি করা হলেও জুলাই সনদ আদেশের মধ্যে এমন কিছু অস্পষ্টতা রয়ে গেছে যাতে করে জুলাই সনদের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়। তিনি বলেন, গণভোটকে কয়েকটি প্রশ্নে ভাগ করা হয়েছে। এই ভাগ করার মধ্য দিয়ে সংস্কারের বিষয়গুলোকে একভাবে না দেখে সংস্কারের পয়েন্টগুলোকে আলাদা আলাদাভাবে দেখানো হয়েছে। কিছু কিছু সংস্কারকে কম গুরুত্বপূর্ণ করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর বিবেচনায় করে ফেলা হয়েছে। যে বিষয়গুলোতে গণভোটের কথা বলা হয়েছে সেখানে বলা হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহ জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গঠিত হবে। কিন্তু এখানে প্রশ্ন থেকে যায় যে, জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়া। এই বাক্যের মধ্যে এই অস্পষ্টতা রয়ে গেছে যে সেটা কি নোট অব ডিসেন্টসহ জুলাই সনদ নাকি নোট অব ডিসেন্টের কার্যকারিতাবিহীন?
তিনি বলেন, যেহেতু এই জায়গায় একটা অস্পষ্টতা রয়ে গেছে যে, জুলাই সনদের প্রক্রিয়া অনুযায়ী এটাকে বাস্তবায়ন করা হবে এবং নানা পক্ষ এখানে রয়েছে যারা আসলে নোট অব ডিসেন্ট সহকারে জুলাই সনদকে এবং এই গণভোটের ফলাফলকে দেখতে চান। তারা যদি ক্ষমতা প্রাপ্ত হন সেক্ষেত্রে এই জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়া সেটাকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে বা তাদের মতো করে ব্যাখ্যা করে সেখান থেকে নোট অব ডিসেন্টের যে ইস্যুটা আছে সেটাকেই তারা প্রধানতম করে তোলার সুযোগ পেয়ে যাবেন এই টেক্সটের মধ্য দিয়ে। অতএব গণভোটের প্রশ্নে সুরাহা হওয়ার পরে জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়া অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করা হবে। এই বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট আছে কি নাই, এ ব্যাপারে আমরা সরকারের কাছ থেকে স্পষ্ট ব্যাখ্যা দাবি করছি।
তিনি আরও বলেন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান কোনগুলো তার সঠিক কোনো সংজ্ঞায়ন এখানে নেই। আমরা দুর্নীতি দমন কমিশনকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার কথা দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা করেছি। কিন্তু সেই দুদক এখনো পর্যন্ত বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী কোনো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নয়। কিন্তু আমরা যে বিষয়টিতে একমত হলাম এবং ঐকমত্য কমিশন তাতে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে সেই দুর্নীতি দমন কমিশন সেটা কি অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত থাকবে কি থাকবে না সে ব্যাপারেও কিন্তু এই সনদের বাস্তবায়নের যে আদেশ তাতে পরিষ্কার করা হয় নাই।
এনসিপির সদস্যসচিব বলেন, এরপর উচ্চকক্ষ গঠনের কথা বলা হয়েছে। এবার যে উচ্চকক্ষ গঠিত হবে অর্থাৎ সনদের অব্যবহিত পরের যে উচ্চকক্ষ সেই উচ্চকক্ষে তারা প্রতিনিধি হিসেবে যাবেন তাদের তালিকা প্রকাশ না করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এর অর্থ কি এরকম যে, এবার তালিকা প্রকাশ করা হলো না কিন্তু পরবর্তী সময় থেকে উচ্চকক্ষের নির্বাচনের আগেই তাদের ক্যান্ডিডেটের তালিকা প্রত্যেকটা দলকে প্রকাশ করতে হবে! এই বাধ্যবাধকতার কথাটি এই জুলাই সনদে উপেক্ষিত থেকে গেছে। নারী প্রতিনিধি অন্তত যেন ১০ শতাংশ উচ্চকক্ষে মনোনীত হন। সে বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের সব রাজনৈতিক দল আমরা আলাপ-আলোচনা করেছি। কমিশন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। কিন্তু সেই বিষয়টা তো এই তালিকা প্রকাশ করার যে অংশ সেখানে উল্লেখ করা হয় নাই।
আখতার হোসেন বলেন, সংবিধানের আর্টিকেল ৭০ রাজনৈতিক দলগুলো যারা যেভাবে বলেছে গণভোটের সিদ্ধান্ত পাস হলেও তারা তাদের মতো করে করার এখতিয়ার রাখেন। একই ব্যক্তি একাধিক পদে থাকার বিধান অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী একাধিক পদে থাকতে পারবেন কি না। আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো সংসদ দ্বারা অনুমোদিত হতে হবে কি না এমন অনেক বিষয় রয়েছে যে বিষয়গুলোতে অনেক দলের নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। কিন্তু সেই নোট অব ডিসেন্টগুলোকেই প্রধান করে তোলা হয়েছে। যেহেতু বলা হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো তারা তাদের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেই সংস্কার পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করবে। যদি গণভোটের মধ্য দিয়ে জনগণ তারা তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন তারপরও কেন রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের মত অনুসারে সংবিধান সংশোধনের সুযোগটা প্রদান করা হলো সেই বিষয়টাতে একটা অস্পষ্টতার জায়গা তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা চেয়েছিলাম জুলাই সনদের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন। কিন্তু এই আদেশের মধ্যে জুলাই সনদের সংস্কার প্রস্তাবনাগুলোকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে সেগুলোর মধ্যে গুরুত্বের ও গুরুত্বহীনতার বিচার তৈরি করে এটার আংশিক বাস্তবায়ন এবং আংশিকভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
আখতার হোসেন বলেন, জুলাই সনদের বাস্তবায়ন আদেশের মধ্যে যদি গণভোটে পাস করা বিষয় এবং জুলাই সনদে যে বিষয়গুলোতে আমরা একমত হয়েছি এবং কমিশন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে সেটা যদি সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করা না হয় সেক্ষেত্রে কী ধরনের ফলাফল তৈরি হবে সে বিষয়টা এই আদেশের মধ্যে উল্লেখ করা হয় নাই। আমরা দেখেছি আমাদের দলের তরফ থেকে এর আগেও দাবি জানিয়েছি গণভোটের যে ফলাফল সেটা যেন বাধ্যতামূলক থাকে। সেই গণভোটের ফলাফল থেকে যেন কেউ দূরে সরে না আসতে পারে। এর আগে কমিশন যখন সুপারিশ প্রেরণ করেছিল কমিশন এই কথা জানিয়েছে যে যদি পরের সংসদ সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এই সংস্কার প্রস্তাপনাগুলোকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যর্থ হয় সেক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেগুলো সংবিধানের অংশ হয়ে যাবে।
কিন্তু এবার যে আদেশ প্রণয়ন করা হয়েছে সে আদেশের মধ্যে ১৮০ দিনের একটা টাইম ফ্রেম দেওয়া হয়েছে ঠিকই কিন্তু যদি এই টাইম ফ্রেমের মধ্যে সংস্কারের প্রস্তাবনাগুলোকে পরের সংসদ যেটাকে সংস্কার পরিষদ বলা হচ্ছে তারা যদি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যর্থ হয় সেক্ষেত্রে সেই সংস্কার প্রস্তাবনাগুলোর ফলাফল কী হবে? সেগুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে কি হবে না গৃহীত হবে কি হবে না সে বিষয়ে এক ধরনের অস্পষ্টতা এখানে রয়ে গেছে।
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, এই আদেশ ১৯৭২ সালের ফ্যাসিবাদী সংবিধানের দিকে ফিরে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি করছে, যা জনগণের আকাক্সক্ষার পরিপন্থি।